রেখা আবদুল খালেকের একটা হাত দুমুঠোয় পুরে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে বললে, আমি তোমাকে কোনো দোষ দেই নি। স্বামীর কাছে পুরোনো হয়ে যাওয়ার মতো দুঃখ মেয়েদের কাছে আর কিছু নেই। বোধহয় কলঙ্ককেও তারা এতোটা ভয় করে না। তুমি যাকে অপরাধ বললে, মেয়েদের জীবনের ঐশ্বর্য ঠিক অতোটুকুই। মেয়ে হলে তুমি বুঝতে–
কি জানি, তোমরা বোঝো। ভাত-কাপড়ের বেশি আমার মাথায় বোধহয় আর কিছু ঢোকে না—
রেখা বললে, আমি বুঝি, এখন তুমি হাঁপিয়ে পড়েছে। এখন তো হেঁজিপেঁজিরাও ইচ্ছে করলে একটা চাকরি ধরতে পারে। তুমি যদি অমত না করো ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এ একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারি–
আবদুল খালেক হেসে বললে, আর কি কি ভেবে রেখেছো?
আগে একটু গুছিয়ে নিতে হবে, তারপর একটা মেয়ে দরকার। তোমার তো মেয়ের শখ—
ও মোমিন মিয়াবাই–মরণ ঢালি সামনের দিক থেকে আসা নৌকোর প্রস্রাবে মগ্ন সোয়ারির উদ্দেশে বললে, এলা ফিরান দিয়া হুকার পানি বদল করেন, নায়ের ভিৎরে মানু—
আমন খেতের ফাঁকে ফাঁকে এক একটি ফাঁকা চক, হয়তো পাট ছিল, এখানে সেখানে কেবল বাতাসের নাচন। গলুইতে এসে বসে আবদুল খালেক কিছুক্ষণের জন্যে। কাচের মতো পানি। তলা দেখা যায়। নানাজাতের জলজ উদ্ভিদ দোল খায়। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে পানি থেকে সবুজ ঝাঁঝি তুলতে থাকে আবদুল খালেক।
মাঝি, আমরা কতোদূর?
হপায় সুজানগর পার হয়া আইলাম—
বলেছিলে না আমাদের নামাবে কোথাও?
মরণ ঢালি বললে, জাঙ্গাইলা আয়া লউক, খাওন-লওনের কাম শ্যাষ কইরা অক্করে দিঘলীতে লয়া ফালামু আপনেগো, পদ্মা দেইখা আইবেন।
ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে বাড়িয়ে দিল রেখা। দুখানা বিস্কুট। ধনিচা বনের গায়ে নৌকো রেখে চা খেল মরণ ঢালিও!
আবদুল খালেক বললে, পদ্মার দিকে যে যাবে, ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে না?
মরণ ঢালি বললে, দিনে দিনে মেলা করুম, বেশি রাত হইবো। রাইতে আমার নাও বাওন তো অহনতরি দেহেন নাই, বাওয়া খেতের ওপরদা পিরপিরায়া লগি মাইরা যামু, ঘুরান পথ ধরে কোন বোন্দায়। অহনে খেতে দারা ফালাইলে ব্যাড়ারা কিলাইয়া আর আস্তা থুইবো না–
বয়েস হলেও লোকটা ঝাড়েমুলে এখনো বেশ টন্কো সপ্রাণ। আবদুল খালেকের তাই মনে হলো। নৌকা রেখে একটা ভেঁসাল থেকে সে মাছ কিনলো। ফিরে এসে আবার লগি ধরে একগাল হেসে বললে, আউজকা খাইবেন মাঝির হাতের পাক—
আবদুল খালেক বললে, বলছো কি তুমি?
এলা বয়া বয়া সব দেইখেন, কতো মাইনসেরে পাক কইরা খাওয়াছি। ডাকতরে সব বন্দোবস্ত কইরা দিছে—
দূরে দূরে এক এটি জলবন্দি নিস্তব্ধ গ্রাম। থেকে থেকে এক একবার কোড়া ডেকে ওঠে ধানখেতের মাঝখানে হু-হু বাতাসে সবুজ গন্ধ। সবকিছু শান্ত, কোথাও কোনো দাগ লেগে নেই, কোথাও কোনো জোড়াতালি নেই। এমন অকপট সবকিছু, এমন নির্দোষ যে, নিজের ভারে নিজেকে বিপন্ন মনে হয়।
রেখা বললে, ভিতরে এসে বোসসা, চুপচাপ ভালো লাগে। কেমন দমবন্ধ হয়ে যায় আবদুল খালেক বললে, তোমার ছেলেবেলার কথা বলো, শুনি–
রেখা বললে, আজ থাক, খামোকা মন খারাপ করে কি লাভ। কিছু কিছু তো জানোই। পরগাছার আবার ছেলেবেলা কি?
কখনো কারো জন্যে কাঁদোনি?
মনে পড়ে না—
পুতুলের বিয়ে দিয়ে কাঁদো নি?
সে তো ন্যাকড়ার, কাঁদবো কেন?
আবদুল খালেক হেসে বললে, তখন তোমার বুদ্ধি আরো পাকা ছিল তাহলে?
তাই বলে ন্যাকড়ার পুতুলের জন্যে কেউ কাঁদে?
এও তো ন্যাকড়ারই পুতুল, যাকে নিয়ে সংসার পেতেছো—
ঘোরালো কথা তুলতে পারবে না বলে দিচ্ছি–চোখ পাকিয়ে রেখা বললে, ন্যাকড়ার পুতুল কেন? একটা প্রেম করতে পারছে না বলে? ধরে রেখেছি বলে?
কোথায় ধরে রেখেছো, একে ধরে রাখা বলে? আবদুল খালেক হাসতে হাসতে বললে, আমি তো ছাড়াগুরু ইচ্ছে করলেই পরের খেতের ধান সাবড়ে দিতে পারি!
ইচ্ছে করলেই তো হয়!
ওই ইচ্ছে করাটুকুই হচ্ছে কষ্টের। তুমি বরং আরো একটু বেশি করে ধরে রেখো, কষে, যাতে বাবাগো বলে চেঁচিয়ে উঠি, প্রাণ বেরিয়ে যায়—
আবদুল খালেক হাসতে লাগলো।
কি যে হাসো! বোঝা গেল, রেখা ভালোমতোই চটেছে।
আবদুল খালেক বললে, উহু, তুমি চটে যাচ্ছো, এরকম কোনো কথা ছিল না।
রেখা বললে, তুমি নিজেই তো একটা কিছু বাধাবার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছো–
আবদুল খালেক একটা সিগ্রেট ধরিয়ে খুব সহজ গলায় বললে, কেউ কাউকে ধরে রাখে না, অধিকারটাকে সবচেয়ে বড় করে দ্যাখে বলে ঐরকম মনে হয়। তুমিও আমাকে বেঁধে রাখো নি, আমিও তোমাকে বেঁধে রাখি নি। মানুষ কি গরু-ছাগল-ভেড়া যে, দড়ি দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা যাবে?
রেখা বললে, তোমার একটা কথার সঙ্গে আরেকটা কথার কোনো মিল নেই। তুমি কি সত্যিই সবকিছুকে এভাবে দ্যাখো, না কথার পিছে কথা? এসব যদি সত্যি হয়, তাহলে ঘর-সংসার করার কোনো মানে হয় না—
কেউ যখন ঘর-সংসার করে, তখন সে তার মানে খুঁজতে যায়। মানে খুঁজতে গেলেই বিপদ। চোয়া ঢেকুর তুলতে তুলতে নাককান বুজে সে শুধু তার আয়ু ক্ষয় করে যাবে, আবার কি? মানেফানে নেই বুকে হেঁটে,গড়িয়ে গড়িয়ে, ডিগবাজি খেয়ে তাকে চালিয়ে যেতে হবে, ব্যাস্!
রেখা বললে, এই নিয়ে তর্ক করতে চাই না। এ তোমার শুধু এক ধরনের বলতে পারা, এর ভেতরে কোনো বাহাদুরি নেই। তুমি চুপ করো—
আবদুল খালেক বললে, ঠিক আছে, দুই একটা মাছের নাম করো।
আগে বলো কেন?
বলছি, আগে উত্তর দাও–
ধরো রুই।
একটা পাখির নাম—