আবদুল খালেক হাতের ওপর কাত হয়ে শুয়ে বললে, ভালোই তো!
রোজ রাতে মামীকে সাজতে হতো, কত রকমের যে শখ মামার! কিছু ভেবে রেখা বললে, তোমার কখনো এরকম ইচ্ছে হয়?
সাজলে ভালোই লাগে—
একদিনও তো বললে না?
তুমি যদি আবার অন্য কিছু ভাবো!
কি ভাববো অন্য কিছু?
কতো রকমের সন্দেহ থাকতে পারে—
নিজের মনের জোর থাকলে আবার কি। বলেই দেখতে!
আচ্ছা, এবার থেকে বলবো—
তবু ভালো— রেখা হেসে বললে, শুধু মনে হতো লোকটার কোনো শখ নেই, একটা মরা কাঠের তক্তা ধরে ভাসছি!
আবদুল খালেক অনেক চিন্তা করে বললে, আচ্ছা, মানুষ কি সত্যিই ভালোবাসে, না জীবনভর এইসবের অভিনয় করে?
সেটা তোমারই জানার কথা!
বোঝা গেল খুশি হয় নি রেখা।
আবদুল খালেক বললে, এই সব বোধহয় কথার কথা। সময় নষ্ট করার জন্যে কতগুলো জিনিসকে খাড়া করা। আসল সমস্যা তো ভাত-কাপড়ের–
তা তো দিচ্ছোই!
একে দেয়া বলে না।
তাহলে কি বলে?
কোনোমতে চলে যাচ্ছে। তুমি চালিয়ে নিচ্ছো—
এটাই ভালোবাসা, সত্যিই যদি এভাবে থাকো। তুমি কি মনে করো, হাতি-ঘোড়া মারার দরকার হয়? কাছাকাছি থাকলে কোনো কষ্টই নয়, তখন এক ধরনের জোর থাকে মনের, ভেতর থেকে সাহস আসে। যখন মনে হয় মানুষটা কেমন যেন একটু দূরে দূরে, কোনো কিছুতেই জড়াতে চাচ্ছে না, ব্রিত হয়ে আছে, একটার পর একটা আড়াল তৈরি করে যাচ্ছে, একটু একটু করে তখন ভেতরে ভাঙন ধরে।
আবদুল খালেক বললে, তোমার সব কথা আমি বুঝতে পারছি।
রেখা কেঁদে ফেললে। বেশ সময় লাগলো তার নিজেকে সামলাতে। এমন অদ্ভুত সব কথা তার মনের ভেতরে ওত পেতে আছে, সে নিজেই জানতো না। নিছক ওপরের সাজগোজ দিয়ে ঢেকে রেখেছিল নিজেকে, কিন্তু ভেতরে এমন অগোছালো, এমন দলা পাকানো, যে সে নিজেই ভয় পেল। সে বললে, তুমি আমাকে কিছুই দিও না, তোমার কাছে আমি কিছু চাই না, শুধু একটু কাছে থেকো, চিরকাল তোমার হাত যেন আমার গায়ের ওপরে থাকে, চোখ খুলেই যেন প্রথমে তোমাকে দেখি, বেঁচে থাকার জন্যে তুমি শুধু এইটুকু আমাকে দিও—
আমি কি তা দিচ্ছি না?
হয়তো দিচ্ছে, কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারি না, বোঝার ক্ষমতাটাই বোধহয় জট পাকিয়ে গেছে। মনে হয় গায়ের ওপরে তুমি যে হাত রেখেছে তাতে রক্ত নেই, প্রাণ নেই, অন্য কারো হাত। চোখ খুলে যাকে দেখি সে যেন অন্য কেউ অচেনা। কি রকম যে হয়, তোমাকে বোঝাতে পারি না। আগে কখনো এসব মনে হতো না, ঘুমের ভেতর তুমি স্বপ্ন দেখলেও আমি বুঝতে পারতাম। এখন এতো দূর থেকে কথা বলো, এমনভাবে বলো, যেন আমি তোমার কেউ নই। এখন তুমি ভয় করে চলো, গা বাঁচিয়ে চলো; নিজেকে এমনভাবে আড়াল করে রাখো, যাতে আমার চোখে না পড়ো। তুমি তো খেয়ালই করো না, করলে দেখতে, সারাটা রাত শুধু উশপিশ করে কাটাই, ঘুম আসে না, কি যে যন্ত্রণা। একবার দেখি তুমি মড়ার মতো পড়ে আছো, একবার দেখি জেগে আছো, তবু মশারির বাইরে তোমার হাত, মশায় খাচ্ছে, তোমার সাড়াই নেই–
আবদুল খালেক উপুড় হয়ে শুয়ে গলা তুলে দেখলো রেখাকে। রেখার হাতের ওপরে একটা হাত রেখে বললে, আমি জানতাম না তোমার ভেতরে এতো কথা আছে। সকলের ভেতরেই বোধহয় এই রকম আরো একটা আলাদা সংসার পাতা থাকে, সেখানে সে তার খেলার পুতুলের জন্য নিজের যথাসর্বস্ব দ্যায়, এক টুকরো ভাঙা কাচের জন্য বুক ভরে কাঁদে, নিছক কাগজের নৌকো ডুবে গেলে একেবারে সর্বস্বান্তু হয়ে যায়–
রেখা কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো তার মুখের দিকে। এই মুহূর্তে নিজেকে তার খুব অসহায় মনে হলো। সে চায় আবদুল খালেক কিছু বলুক। অনেক কিছু শুনবে বলে সে আজ তৈরি হয়েই নৌকোয় উঠেছে।
আবদুল খালেক বললে, মনি ভাইজানকেও শেষ পর্যন্ত আমি এমনভাবে দেখেছিলাম—
রেখা বললে কিভাবে দেখেছিলে?
সেকথা এখন থাক, কথা যখন উঠেছেই বলবো এক সময়–আবদুল খালেক ডুব দিয়ে ওঠার মতো করে বললে, তবু একটা জলজ্যান্ত রক্ত-মাংসের মানুষের জন্যে তুমি এমন উতলা হয়ে উঠেছে। আর আমার কথা জানো? একটা সামান্য রোগা ঠ্যাং ভাঙা শালিককে দেখতে না পেলে এক সময় এক একটা দুপুর আমার কাছে মিথ্যে হয়ে যেতো। দুপুরটাকে মনে হতো জীবন; নিংড়ে নিংড়ে তার সব আলো এখন কেউ চুষে নিয়েছে। এই রকমই হয়। এই রকম হয় বলেই হাত-পাগুলো ভাঙা থাকে মানুষের। সে খোঁড়া হয়ে থাকে, নুলো হয়ে থাকে, অথর্ব মেরে যায়। হাঁটু মুড়ে ভ্যাবলা হয়ে বসে থাকে। তা না হলে, দাঁত জানে তার কি কাজ, নখ জানে তার কি কাজ, ভেতরের ডাকাতটাকে তো মানুষ ভাত-কাপড় দিয়ে পোষেই। এই রকম হয় বলেই একটা মানুষ তার দুটো হাতকে হাসিমুখে আরেকজনকে বিলিয়ে দিতে পারে, বলতে পারে আর কি নেবে নাও, তোমার যা খুশি নাও। তা না হয়ে চোখের সামনে থেকে একটা চুলও কেউ উড়তে দিতো না, একটা কুটোগাছও তার হাত থেকে গলতো না–
রেখা ভয়ে বললে, আজ কিন্তু আমি তোমাকে রাগ করতে দেবো না। আমার মনে যা যা হয়, তোমাকে শুধু সেই কথাগুলোই বলতে চেয়েছিলাম। তুমি যদি না শোনো আর কাকে বলবো–
আবদুল খালেক অসহিষ্ণু হয়ে বললে, যখন তুমি বললে তোমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে, তখন সব অপরা্ধের বোঝা আমি নিজের কাঁধে তুলে নিলাম। আমার তো মনে আছে, যেদিন তুমি প্রথম এলে, সেদিন কি ছিলে তুমি। দেখে আর আশ মেটে না, সকালে দেখি, দুপুরে দেখি, যতোবার ইচ্ছে দেখি, তোমার সমস্ত শরীর তখন ঝনঝন করে বাজে, শুধু লোভ হয়। একেবারে রাজছত্র খুলে বসলাম। তোমার সমস্ত শরীরকে চাইলাম পাগলামির ভেতর, গুণ্ডামির ভেতর, খুনোখুনির ভেতর। একটা নদী যখন শুকিয়ে যায়, তখন তাকে কেউ অপরাধী বলে সাব্যস্ত করে না, তার কথা মনে করে শুধু দুঃখ পায়। একটা সামান্য মানুষকেও ঠিক এইভাবে দেখো। এইভাবে দেখলে তার ধ্বংসস্তৃপই কেবল তোমার নজরে আসবে। বুকের ওপর দুটো হাত জড়ো করে মার-খাওয়া মানুষ যখন বলে মুঠোয় কি আছে দেখতে চেয়ো না, দোহাই তোমাদের, এ তোমাদের কোনো কাজে লাগবে না, সারাজীবনের সঞ্চয় শুধু এইটুকুই, এই সামান্য স্বপ্নটুকুই, তখন ধরে নিতে হয় সে বেঁচে আছে বেবল স্মৃতির ভেতর। তার চেয়ে নির্বিষ, তার চেয়ে নিরাপদ জানোয়ার আর কে!