আবদুল খালেক বললে, কিছুটা নয়, বোধহয় সবটাই কম্প্রোমাইজ—
ঐ একভাবে চালিয়ে নিতে হয় বেহায়ার মতো। আমার তো ধারণা, বিদ্যাফিদ্যা জ্ঞানট্যান জীবনে কখনো কাজে লাগে না। ওগুলোর জন্যে খামোকা মানুষ নিজেকে অপব্যয় করে। কালকে কলে বেরিয়েছি, পথে খুব ইচ্ছে হলো এক কাপ চা খাই। মাঝিকে বললাম, নৌকো ভেড়াবে চায়ের দোকান পেলে। এক সময় খালের পাশে নৌকো ভিড়িয়ে সে গেল চা আনতে। চুমুক মেরে দেখি অপূর্ব চা, মাঝিকে বললাম, কোন্ দোকান থেকে এনেছে গো, খুব ভালো তো! সে কি বললে জানেন? বললে প্রথমে যে চা দিয়েছিল সে আপনি মুখে দিতে পারতেন না, গরুর চোনাও তার থেকে ভালো বরং। যখন মিথ্যে করে বললাম নৌকোয় ওসি সাহেব আছে, বেরুল স্পেশাল পাত্তি, এখন বুঝুন। মাঝিটা গোমুখ্য, তবু খুব সহজেই সে একটা সমস্যার সমাধান করে ফেললো। জীবনের সবকিছু এই হালকা চালে নিতে পারাটাই ভালো–
আবদুল খালেক উঠে দাঁড়িয়ে বললে, আর বসবো না, ক্লাস নিতে হবে এবার, আপনি নোভালর্জিন দিন!
নরহরি ডাক্তার অসহিষ্ণু হয়ে বললে, এই তো আপনাদের এক দোষ, রোগটা কি না বুঝেই আন্দাজে ওষুধ গেলা কি ভালো? নিজেরা আন্দাগোন্দা নিজেদের ওপর ডাক্তারি চালাবেন না, যেকোনো সময় বিপদ ঘটে যেতে পারে, না-কি মিথ্যে বলছি!
০৯. আলো ছায়ায় যুগলবন্দি
পচ্চিমে বাতাস ছারছে, লাগে জানি পানি হুকায়া যাইবো।
আবদুল খালেক জিগ্যেস করলে, মরণ, এটা কোন্ গ্রাম?
চন্দনধুল।
কাছাকাছি নদী নেই?
আছে না! হাপেরচরের শ্যাষমুখে হইল গিয়া আপনের বরগাঙ, ইছামতি।
আবদুল খালেক বললে, সুন্দর গ্রাম পড়ে পথে?
পাইবেন। গেরামের অভাব নাই। রাজাদিয়া, টেংগুইরপারা, পাওলিদিয়া, বাহিরঘাটা–
তোমার কথা ও বোঝেই নি–রেখা বললে।
আবদুল খালেক বললে, এদিকটা তোমার ভালো লাগছে?
কেমন যেন! শুধু আখখেত আর আখখেত, কোনো কিছু দেখা যায় না–
তাহলে অন্যদিকে ঘোরাতে বলি, কি বলো?
তুমি যা ভালো বোঝে।
আবদুল খালেক মরণ ঢালিকে বললে, নৌকো ঘোরাও বাপু, না হয় আড়িয়লের দিকে চল—
মরণ ঢালি বললে, আইজ আর ফেরন লাগবে না, বিলের মাইদ্যে রাইত কাটাইতে পারবেন নি-ও?
তাহলে তোমার যেদিকে খুশি সেদিকে যাও, গ্রামের পাশ দিয়ে যাবে—
একটার পর একটা গলাপানিতে ডোবা আখখেত। না দেখা যায় মানুষজন, না কোনো গ্রামের মাথা। বাতা আর ছইয়ের গায়ে তুমুল বৃষ্টির শব্দ তুলে আখবনের দাঁড়া ভেঙে লগি মেরে চলেছে মরণ ঢালি।
বনময় টুব-টু-টুব শব্দ। একটার পর একটা ঢিল এসে পড়ছে পানির ওপর, ডাইনে বায়ে, চতুর্দিকে; এইরকম মনে হয় এক একবার। কখনো মনে হয় পানির ওপরে একটা তার টান টান করে বেঁধে অবিরাম টুব-টুব-টুব বাজিয়ে চলেছে কেউ। রেখা কান পেতে শুনছিল। আবদুল খালেক বললে, ডাহুক—
তাই বুঝি—
নৌকোয় ওঠার আগে কাঁদছিলে কেন?
এমনিই!
তুমি খুব কষ্ট পাও, তাই না?
রেখা ভাঙা গলায় বললে, তোমার আর কি কি মনে হয়?
একটু ভেবে নিয়ে আবদুল খালেক বললে, আমি তোমাকে কোনোদিন বোঝার চেষ্টা করি নি, এইসব মনে হয়। বরং উল্টোটা করেছি। একতরফা তোমার কাঁধে নিজের অনেক কিছু চাপিয়েছি। তোমাকে যে আমার কিছু দেবার আছে, এসব ভাবি নি, কেবল দাবি করে এসেছি তোমার কাছে। ধর কালকের কথা, তুমি না এক সময়ে বললে, তোমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে, তাই তোমার খুব চিন্তা। ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার কাছে খুব ছোট হয়ে গেলাম। একটা মেয়ে, তার জীবনের সবকিছু দিয়ে একজনকে ধরে রাখতে চায়, তার সব চিন্তার শেকড় ঐ এক মাটিতে, ঐ এক জায়গায় শক্ত করে বাঁধা, আমি ভাবতেও পারি না, কোনোদিন ভেবে দেখি নি এভাবে। এ চিন্তা তো আমারও হতে পারতো, একটি মেয়ে, জীবনভর তাকে চাই, তাকে ছাড়া আমার চলবে না, সবকিছু অন্ধকার, অর্থহীন তাকে ছাড়া, ভীষণভাবে পেতে চাই, কই কখনো তো মনে হয় নি। তাকে আমার ধরে রাখতেই হবে, যেভাবেই হোক একবারও মনে হয় নি। বেশির পক্ষে সবকিছু ছিল এই রকম, সে আছে, চলে যাচ্ছে, চলে যাবে। জিনিসটা দাঁড়াচ্ছে এই, তার তো আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, পালাবার কোনো পথ নেই, যেমন আছে, তেমনি থাকবে। শুনতে যতোই খারাপ লাগুক, একটা অস্পষ্ট ধোয়াটে ব্যাপার গোটা জিনিসটা। তুমি আমাকে অনেক সুখ দিয়েছে, রেখা আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ
রেখা বললে, তুমি না বলেছিলে কেউ কারো দুঃখ নিয়ে ঘাটাঘাটি করবো না, অন্তত এই দিনটায়, ভুলে গেলে? এসব কথায় মন খারাপ হয়ে যায়।
এসে যায়। আমরা একে অপরের এতো চেনা যে, নিজেদের বাইরে যেতে পারছি না। এর বাইরে যেতে গেলেই সবকিছু সস্তা অভিনয় হয়ে যাবে! তখন এভাবে ভেবে দেখি নি।
রেখা বললে, তুমি আর একটু ভেতরের দিকে এসে বসো, মুখে রোদ লাগছে।
আবদুল খালেক সরে এলে রেখা বললে, ডাহুকগুলো ওভাবে ডাকছে কেন?
ডিম দেয়ার সময় এখন। বর্ষার পানি থাকতে থাকতে দুতিনবার ডিম দেয় পাখিগুলো—
টুকুর জন্যে খুব খারাপ লাগছে, নিয়ে এলেই হতো—
আবদুল খালেক বললে, মোমেনার সঙ্গে ও দিব্যি থাকবে।
আমরা কোনদিকে যাচ্ছি?
একদিকে গেলেই হয়–
একটা সিগ্রেট ধরায় রেখা। আলতোভাবে টান দিতে গিয়ে সে কেশে ওঠে। বললে, নাও, ধরো–
আবদুল খালেক বললে, আরো দুটো টান মার না, কি হবে।
না বাপু! এমনিতেই কেমন যেন গা গোলাচ্ছে–
দুজনে খেলে ভালোই লাগে!
মামাও এরকম বলতো—
বলতো নাকি?
তোমার বোধহয় বিশ্বাস হয় না? রেখা হেসে বললে, ওপর থেকে দেখে মামাকে ওই রকম কাটমোল্লা মনে হয়, ভেতরে ভেতরে রস আছে বুড়োর। রোজ শোবার ঘরের দরোজা বন্ধ করে মৃতসঞ্জীবনীর বোতল নিয়ে বসতো মামা। বলতো স্বাস্থ্যটা একটু ভালো করা দরকার, বল পাই শরীরে। মাঝে মাঝে মামীও খেত। মামাই বোধহয় জোর করে খাওয়াতো। তারপর সে কি হাসাহাসি। দুএক সময় এমন হুটোপুটি বেধে যেতো ঘরের ভেতর, আমার নিজেরই লজ্জা লাগতো।