এই তো মিনিট পাঁচেক হবে। ঘণ্টা দেড়েকের একটা গ্যাপ, ভাবলাম একটু বসে যাই–
বসুন আপনি–সিগ্রেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে নরহরি ডাক্তার বললে, হাতের কাজগুলো একটু হালকা করে নিই। রুগী বিদায় করতে করতে প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে যায়। সামনের দোকানে চায়ের কথা বলে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বললে, খুব দেখালেন সেদিন, আমি তো গিয়ে বোবা–
আবদুল খালেক বললে, ওষুধটা পাই নি।
তা না পান, আমি তো ছিলামই, কি যে করেন আপনি!
এই সময় একটি লোক এসে দাঁড়ায় সামনের খুঁটি ধরে। নরহরি ডাক্তার এক তাড়া মেরে বললে, আবার কি? তুমি তো আজব মানুষ হে? যা করার ছিল করেছি, এখন আর আমার হাতে কোনো চিকিৎসা নেই। খামোকা ফেউ লাগো কেন পেছনে! সোজা ঢাকায় নিয়ে যাও, হাসপাতালে ভর্তি করাও, আর কোনো রাস্তা নেই–
আবদুল খালেকের হাত থেকে দেশলাই নিয়ে নরহরি ডাক্তার বললে, এগুলো একটাও মানুষ না, সব জানোয়ার! ঘরের বউগুলোকে এরা গরুছাগলের বেশি কিছু মনে করে না। এদের আর কি, ভোগান্তি হয় বেচারা বউগুলোর।
আবদুল খালেক জিগ্যেস করলে, কি, হয়েছে কি?
প্রল্যাপস্ অব ইউট্রাস! বিশদিনও হয় নি বাচ্চা বিইয়েছে বৌটা, তাকে পাঠিয়েছে বাড়ি বাড়িতে ঢেঁকিতে পার দিতে, কতো বড় অমানুষ!
আবদুল খালেক বললে, আমাকে নোভালজিন দেবেন। একটু ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো লাগছে—
সে হবেখন, নরহরি ডাক্তার বললে, ভাবী ডেকে পাঠিয়েছিলেন। নৌকো ঠিক করে দেবার জন্যে–
বলেন কি!
আশ্চর্য হবার কি আছে এতে। বললেন, এই বর্ষার পানিতে একদিন নৌকায় করে বেড়াতে চান, অনেকদিনের ইচ্ছে নাকি। বললেন ভালো দেখে একটা নৌকোর বন্দোবস্ত করে দিতে। আপনার ওপর ভরসা নেই আর কি, কি বুঝলেন।
আমিও আপনাকে বলতাম।
তা কবে যেতে চান?
যে-কোনোদিন, তবে বন্ধের মধ্যে হলেই ভালো হয়—
আপনাদের কলেজ তো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে?
আরো হপ্তাখানেক খোলা আছে, তারপর দেড় মাসের ছুটি। কালকের ব্যবস্থাও করতে পারেন, একটা মাত্র ক্লাস, নেবো না দরকার হলে—
কাল যেতে চান?
বন্দোবস্ত হলেই যাই—
ঠিক আছে, আমি সব ব্যবস্থা করে রাখবো। আজ রাতেই মরণ ঢালিকে বলবো। বেরুবেন কখন?
ধরুন সকালের দিকেই—
ঠিক আছে।
একটু পরে নরহরি ডাক্তার বললে, তা ছুটিটা কাটাবেন কোথায়?
আবদুল খালেক বললে, কোথায় আর যাবো, এখানেই থাকবো। ঢাকায় গেলেই খরচ, অতো টাকা কোথায়!
খরচ তো এখানেও আছে, নরহরি ডাক্তার বললে, এই-তো আজ সকালেই, দেড় বিঘত একটা গৰ্মার দাম চাইলো পচিশ টাকা,এসব এক সময় ফেলা যেত।
আবদুল খালেক বললে, জীবন বাঁচানোই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন—
তবে একটা কথাও আছে, পাহাড় মনে করলেই পাহাড়, তুলো মনে করলেই তুলো, যে যেভাবে নেয়। হিসেব করে দেখলে বুঝতে পারবেন, কত মানুষের চেয়ে আমরা ভালো আছি। কোনো না কোনোভাবে জীবন চলেই, কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে না। এখানকার রুগীদের কথাই ধরুন। স্রেফ কারমিনেটিভ আর এ্যালকালি মিক্সচারে তাদের জীবন চলে যাচ্ছে। টিনচার কার্ডকো নেই, পট সাইট্রাস নেই, তাতে কি, ধুমসে কারমিনেটিভ দিয়ে যাচ্ছি, এ্যালকালি দিয়ে যাচ্ছি, ধড়াধড় ভালোও হয়ে যাচ্ছে, একবার ভেবে দেখুন ব্যাপারটা। যারা দশজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে চায়, তাদের কথা অবশ্য আলাদা। তার জীবনের ঘাটতি ছাড়া আর কিছুই দ্যাখে না, দেখতে পারে না।
আবদুল খালেকের মনে হলো তার বিশেষ কিছুই বলার নেই। পট সাইট্রাসের অভাবে এ্যালকালি চলে, হয়তো রোগও সারে, কিন্তু তার নিজের কাছে জীবন জিনিসটি এমন, সামান্য একটা অভাব সেখানে সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে। এক একজনের কাছে এক একটা দিক বড়, সেখানে সে কোনো ঘাটতির কথা ভাবতেই পারে না, সুতোর সামান্য একটু টানে সবকিছু যেখানে হুড়মুড় করে ধসে পড়ে। একটা গৰ্মার দাম একশো টাকায় উঠলে তার কোনো মাথাব্যথা নেই, সে তখন মাছ খাওয়ার অভ্যেসটাকে টুক করে ফেলে দেবে, ভাববে, যাক, বাঁচা গেল। কিন্তু কেউ যদি তাকে হেলাফেলা করে, তাচ্ছিল্য করে, বলে তোমার মতো লোক দুদশটা আমার পকেটে থাকে সবসময়, তখন হয়তো তার আত্মহত্যার কথা মনে হবে। অথচ সে নিজে জানে, সে এমন কোনো মাথাওয়ালা লোক নয়, হাতি-ঘোড়া-বাঘ-ভালুক নয়, পকেটে থাকা জীব, এইমাত্র। বিয়ের আগে সে ভাবতো, প্রেম ছাড়া জীবন অচল, এখন মনে করে ওটা একটা ভোঁতা ধারণা, জীবনে এর কোনো প্রয়োজনই নেই, বরং একটা বিড়ম্বনা। বিড়ম্বনা এই জন্যেই, এর কোনো রয়ে-সয়ে চলার ক্ষমতা নেই, এ শুধু আড়ম্বর চায়, লোক দেখানো বৈভব চায়।
নরহরি ডাক্তার বললে, বাইরে থেকে দেখে আমাকে কি মনে হয়, বেশ ভালো আছে লোকটা, দিব্যি দুটো করে খাচ্ছে, কোনো সমস্যা নেই। ব্যাপারটা কি সে রকম? পরপর দুদিন চুনোপুঁটি দিয়ে দায় সেরেছি, ভেতরে ভেতরে ইচ্ছে, যে দামই হয় মাছ আজ কিনবোই। গোটা বাজারে একটা মাত্রই গর্মা। দাম করছি, পেছন থেকে কেউ একজন টিটকারি মেরে উঠলো, ব্যাটা মালাউনের জন্যে বাজারে মাছ কেনার উপায় নেই, টাকার গরম দেখায়। এর কোনো মানে আছে? ভালো খাওয়ার উপায় নেই, ভালো পরার উপায় নেই, ভালোভাবে থাকার উপায় নেই, অথচ ক্ষমতা আছে, এভাবে মানুষ টিকতে পারে! দুদিন অন্তর ডাকাতি। একবার তো মুখের ওপর তারা বলেই ফেললে, যাও না শালা, পড়ে আছো কেন, তোমার বাপের দেশে যাও। তবু মাটি কামড়ে পড়ে আছি। নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিই, অনেকের চেয়ে ভালো আছি। বেঁচে থাকতে হলে কিছুটা কম্প্রোমাইজ তো করতেই হয়–