তাহলে ভিক্ষের কথাটা তুললে কেন?
এখন বুঝে দ্যাখো, কিভাবে তোমাকে দিতে হবে–
অনেক চিন্তা করে রেখা বললে, যদি ভুল হয়ে যায়, বলে দেবে তো?
আবদুল খালেক হেসে বললে, তোমার কখন ভুল হয়?
আবদুল খালেক তখন কলেজে, মোমেনাকে দিয়ে নরহরি ডাক্তারকে ডাকিয়ে আনলো রেখা।
সকালের এই সময়টাই ভীষণ ব্যস্ত থাকে নরহরি ডাক্তার। বেলা বারোটার আগেই বাজার ভেঙে যায়, বাজারের সময়টুকুতে রুগীর ভিড় লেগে যায়, তারপর সব ফাঁকা। তালাচাবি বন্ধ করে তখন কলে বেরিয়ে পড়ে।
নরহরি ডাক্তার মোমেনাকে বলেছিল, পরে গেলে চলে না? এতো রুগী ফেলে যাই কি করে—
আপনাকে এখনই যেতে বলেছে।
রেখা মোমেনাকে বলে দিয়েছিল, একদৌড়ে যাবি। ডাক্তার বাবুকে একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি।
কি ব্যাপার? নরহরি ডাক্তার চিন্তিত মুখে ঢুকে বললে, আবার ট্রাবল দেখা দিয়েছে নাকি?
রেখা বললে, আপনি বসুন। শরীর আমার ভালোই আছে—
নরহরি ডাক্তার রেখার ভেতরে এক ধরনের অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য দেখতে পেল। বললে, আমাকে কিন্তু এক্ষুণি উঠতে হবে, বহু রুগী বসিয়ে রেখে এসেছি।
রেখা জড়িয়ে জড়িয়ে, খুব বিব্রতভাবে বললে, আমি খুব অশান্তিতে আছি ডাক্তার বাবু, আপনাকে কিছু বলবো–
নরহরি ডাক্তার বললে, তাহলে হাতে সময় নিয়ে পরে আসি?
রেখা জিদ ধরে বললে, কথাগুলো আমি টুকুর আব্বার সামনে বলতে চাই না। এখানে এমন কেউ নেই, যাকে এসব বলি, এসব বলা যায়। আপনাকে শুনতেই হবে, সেজন্যেই ডেকেছি—
নরহরি ডাক্তার পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাড়গলা মুছলো। বললে, বেশ, বলুন–
রেখা দরোজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে দুঃখিত গলায় বললে, আপনার ওখানেই তো সব সময় ওঠা-বসা করে, কিছুদিন যাবৎ ওনার চালচলন লক্ষ্য করেছেন?
কৈ তেমন কিছু তো দেখি নি।
কারো সঙ্গে তেমন কথাই বলে না, সবসময় কেমন যেন মনমরা, মনমরা, একা একা থাকে, কি যে চায়, আমি বুঝি না—
নরহরি ডাক্তার বললে, তা উনি তো সবসময় একটু উদাসীন ধরনের মানুষ–
আমি তো ওকে চিনি– রেখা জোর দিয়ে বললে, আগে এমন ছিল না। এখন থেকে ও যেন কোনো কিছুতে নেই। দিলে খায়, না দিলে চুপ করে বসে থাকে। রাতভর জেগে জেগে কিসব করে—
নরহরি ডাক্তার বললে, এই রাত জাগাটাই হচ্ছে ওনার কাল। এতে বায়ুর প্রকোপ বাড়ে, এ্যাসিডিটিতেও ভুগছেন। আসলে উনি একটু রোমান্টিক ধরনের। রাত জাগাটা বন্ধ করাতে হবে আপনাকে।
রেখা বললে, রাতে একা বসে বসে কাঁদে—
বলেন কি?
আমার মনে হয় ও কারো প্রেমে পড়েছে!
নরহরি ডাক্তার সাপ দেখার মতো চমকে ওঠে বললে, এসব কি বলছেন আপনি? আমি তো বাজারের লোক, তেমন কিছু ঘটলে আগে আমার কানে আসতো কথাটা। এমন চিন্তা করাও অন্যায়, ওনাকে আমি খুব ভালো করেই চিনি–
আপনারা সবাই আছেন, একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন–রেখা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, হয়তো এখন সময় আছে, ফেরানো যাবে। আমার মন ভেঙে গেছে—
কি আশ্চর্য কথা— নরহরি ডাক্তার বললে, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, কোনো কিছু হয় নি। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, তেমন কোনো কিছু যদি বের হয়, সোজাসুজি আপনাকেই তা জানাবো। ভাবাও অন্যায়, কি চমৎকার একটা মানুষ। আমার তো আর কারো সঙ্গে তেমন জমে না! ওই ওনার সঙ্গেই যা দুটো কথা হয়, তা নইলে এখানে আর মানুষ কোথায়!
রেখা বললে, হঠাৎ কি খেয়াল চেপেছে মাথায়, আমাকে নিয়ে নৌকোয় বেড়াতে চায়—
তা সে তো ভালো কথা!
আমার ভালো লাগছে না—
বেড়ানোর শখ তো ওনার সব সময়–নরহরি ডাক্তার বললে, প্রায়ই আমাকেও তো ধরেন। আমার কাজই হচ্ছে ঘোরাঘুরি, সময় করে উঠতে পারি না বলে যাওয়া হয় না। এই তো সেদিন কথা হলো, খুব শিগগির একদিন রাঢ়িখাল বজ্রযোগিনী এইসব দিকে ওনাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো।
রেখা বললে, আমার মন ভালো বলছে না—
এর ভেতরে আবার কি দেখলেন?
মনে মনে ও একটা কিছু ঠিক করেছে, এ আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। না পারছে গিলতে, না পারছে ওগরাতে। এখন আমি ওর গলায় আটকে আছি। যে-কোনোভাবে ও আমাকে সরিয়ে দিতে চায়। কান্নায় আবার রেখার গলা ভেঙে গেল, বললে, অথচ এক সময় আমি ছাড়া আর কাউকে কখনো চিনতো না, মুখ তুলে তাকাতো না কোনোদিকে। কোনো দুঃখ ছিল না আমার। আর আজ, এই একটা ছেলে নিয়ে, কোথায় দাঁড়িয়েছি!
নরহরি ডাক্তার বললে, এসব কথা আর কাউকে বলবেন না! বলা উচিত নয়। এমনকি আমাকেও বলা উচিত হয় নি। এসব ভেবে নিজের মনের অশান্তি বাড়াবেন না, কি অবস্থায় যে আছেন, খুব ভালো করেই তা বুঝতে পারছি–
নৌকোর ব্যবস্থাটা আপনি করে দেবেন, ভালো করে বুঝিয়ে বলবেন মাঝিকে, পারবেন না?
নরহরি ডাক্তার হো-হো করে হেসে বললে, জয় গোবিন্দ! আপনাকে আমার গুরু মানা উচিত, পাগল হয়ে যাবো, আমি পাগল হয়ে যাবো! সে যাকগে, আমি এখন উঠি, বিশ্বাস আছে তো আমার ওপর?
রেখা বললে, তা না হলে আপনাকে এসব বলবো কেন?
তাহলে নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে ওনার সঙ্গে বেড়াতে বেরুবেন, যা যা করতে হয় আমি সব করে রাখব, আপনি শুধু যাবেন। ঐ ট্রিপের যাবতীয় খরচ আমার। এই তো আপনাদের দোষ। কোথাও নড়াচাড়া করবেন না, ঘরের কোণায় গোঁজ হয়ে বসে থাকবেন, মন ভালো থাকবে কোত্থেকে! গায়ে একটু আলো-বাতাস লাগাতে হয়। রোজ অন্তত আমাদের বাড়ির দিক থেকেও তো একবার ঘুরে আসতে পারেন।
নরহরি ডাক্তার ফিরে এসে দেখলো; আবদুল খালেক তারই অপেক্ষায় বসে। জিগ্যেস করলে, কতোক্ষণ?