কি বলে? চোখ কুঁচকে রেখা জিগ্যেস করে।
মাধু মাধুরী–
কি জানি বাবা, তোমার কোনো কথাই আমার মাথায় ঢোকে না।
উপুড় হয়ে শুয়ে আবদুল খালেক বললে, আমার খুব ইচ্ছে হয় তোমাকে ঐ নামে ডাকি!
রেখা বললে, মাধুরীটি কে?
তা জানি না। মাধুরী বলে কেউ কোনোদিন বোধহয় ছিল না। কেউ কোনোদিন তাকে দ্যাখে নি, কেউ কোনোদিন তার নাম শোনে নি, বোধহয় এই রকম— আবদুল খালেক বলতে থাকলো, কিন্তু আমার মনে হয় সে আছে, হয়তো তুমিই মাধুরী, আমি চোখ খুলে কখনো দেখি নি, তাই চোখেও পড়ে নি–
কি মানে এসবের?
ঠিক আছে–আহত গলায় আবদুল খালেক বললে, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি ঐ নামে ডাকবো না, ঠিক আছে। এতে রাগের কিছু নেই।
আমি তা বলি নি। তোমার কি দোষ জানো, কোনো কথা তুমি মন খুলে কখনো বলো না, পরিষ্কার বুঝিয়ে বলা তোমার ধাতে নেই–
আবদুল খালেক বললে, একদিন তোমাকে একটা অনুরোধ করবো, তোমাকে কিন্তু রাখতে হবে, অন্তত চেষ্টা কোরো রাখতে। আমি তো তোমার স্বামী। ধরো স্বামী যদি কখনো সামান্য একটা ভিক্ষা চায়—
রেখা তাকে জড়িয়ে ধরে বললে, তাই বলে তুমি কাঁদবে? কাঁদছো কেন, কি করেছি আমি?
আবদুল খালেক কোনো উত্তর না দিয়ে সেইভাবেই উপুড় হয়ে রইলো।
রেখা নিজেও কেঁদে ফেললে। পাথরের মতো শক্ত আবদুল খালেকর গা ধরে তাকে নড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললে, কাঁদছো কেন, কি করেছি আমি!
তুমি কিছু করো নি, কেউ কিছু করে নি–
কাল রাতেও অন্ধকারে বসে বসে সে কাঁদছিলে। কেন এমন করে কাঁদো, হয়েছে কি তোমার?
আবদুল খালেক বললে, বুঝতে পারি না—
এভাবে কেউ কথা বলে— রেখা আবদুল খালেকের পিঠ ভাসিয়ে দিয়ে বললে, আমার কাছে তোমার জোর নেই? দাবি নেই? অধিকার নেই? ভিক্ষে চাইবে কেন? আমার কষ্ট হয় না!
ঠিকই–আবদুল খালেক নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললে, এভাবে বলাটা আমার ভুল হয়েছে। দিন দিন নিজের কাছ থেকেও যেন দূরে সরে যাচ্ছি। তোমাকে আমি সব বলবো। আগে নিজে বুঝে নিই। এক একবার মনে হয়, আমি কোনো মানুষই নই। পদার্থ বলে কোনো জিনিসই নেই আমার ভেতর। সবটুকু একটা আস্ত গোঁজামিল। জোড়াতালি।
রেখা বললে, এসব ভাববা কেন! ভেবে কি হয়! কেন তুমি নিজের সঙ্গে এভাবে শত্রুতা করবে
আবদুল খালেক কোনো কথা বলে না। সেই একইভাবে পড়ে রইলো উপুড় হয়ে। তারপর কোনো একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
দুপুরের দিকে রেখা যখন তার গা ধরে সাড়া দিয়ে জাগালো তখন তার চোখ লাল। তখনো বেশ জ্বর গায়ে। জোর করে একগ্লাস দুধ খাওয়ালো সে।
আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুই? রেখা জিগ্যেস করলে।
টুকু কই?
ঐ তো, ঘুমিয়ে—
শোও তাহলে—
রেখা আবদুল খালেকের গলা জড়িয়ে শোয়।
আবদুল খালেক মুগ্ধ গলায় বললে, তোমার গায়ের গন্ধ ভারি সুন্দর। মনে হয় কখনো কোনো মানুষজন মাড়ায় না এমন একটা চুপচাপ নিস্তব্ধ সরু রাস্তা ধরে হাঁটছি, এক চিলতে রোদ নেই, কেবল সারি সারি বকুল গাছের আদুরে ছায়া—
রেখা বললে, যা সুন্দর করে তুমি বলো, অন্য মেয়েরা শুনলে রোগা হয়ে যাবে—
খুলি?
তোমার ইচ্ছে—
আবদুল খালেক রেখার ব্লাউজের বোতাম খুলে দিয়ে একটা হাত রাখলো সেখানে। বললে, এতো নরম, এতো মায়া!
রেখা বললে, তোমার ভালো লাগে?
মরে যেতে ইচ্ছে করে—
তুমি তো আজকাল দ্যাখোই না। টুকু হবার পর থেকে তোমার যেন আর ভক্তি নেই—
টুকু যখন তোমার কোলে এলো, তোমাকে দেখলাম, গর্ব হলো, তুমি কি সুন্দরই না হয়েছে। যখন কোলে নিয়ে বসে থাকো, নানান ছলচাতুরি করে তোমাকে দেখি। মনে হয় জীবনভর দেখি। আগে দেখতাম শুধু চোখ দিয়ে, এই প্রথম আমার মন দিয়ে দেখতে শেখা—
রেখা বললে, রাতে তোমার হাত গায়ে না থাকলে আমার ঘুম আসে না–
অভ্যেস করেছে বলে হয়তো অমন হয়।
তুমি চাও না আমি ঘুমাই?
একশ বার চাই।
তাহলে অমন কুঁকড়ে হাত-পা মুড়ে শুয়ে থাকো কেন?
তুমি বললেই পারো।
আমাকে বলতে হবে? বলতে যাবো কেন। তোমার যদি ভালো লাগে, জোর করবো কেন। পুরনো হয়ে গেলে মেয়েদের কিইবা এমন থাকে।
আবদুল খালেক বললে, সব থাকে। আমি তো পুরনোই চাই।
রেখা বললে, আমার বুকটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে দিন দিন, এতে মন খারাপ হয়।
মন খারাপের কি আছে?
যদি তোমার ভালো না লাগে, যদি ঘেন্না হয়—
আবদুল খালেক বললে, তোমার ওপর আর অত দাবি নেই আমার। অর্ধেক আমি টুকুকে দিয়ে দিয়েছি।
অনেক পরে রেখা বললে, তোমার ইচ্ছে হয়? কিছু—
আজ থাক—
মন ভালো হয়েছে?
বুঝতে পারছো না?
কি জানি! তোমার বানান বড় শক্ত। দাঁতের গোড়া নড়ে যায়—
আবদুল খালেক বললে, এখন আমার খুব ইচ্ছে, তবু লোভটাকে দমন করতে চাই। আমরা কেউ কাউকে এখনো দেখি নি, কেউ কাউকে চিনি না। খুব শিগগির কোনো একদিন আমাদের দেখা হবে। ধরো প্রথম দেখা। দুজনে সারাদিন কাটাবো এক সঙ্গে। সংসারের কোনো কথা হবে না। না ঝগড়াঝাটি, না তর্কাতর্কি, না কোনো কাজের কথা। দেখতে চাই দিনটা কিভাবে কাটে, কেমন লাগে। তারপর হয়তো সবই হবে। কেমন হবে?
খুব ভালো হবে। কিন্তু কোথায় কিভাবে কাটাবে?
ধরো একটা নৌকোয় সারাদিন কাটাবো, পারবে না?
পারবো। খুব আনন্দ হবে—
ঐদিন আমরা দুজন দুজনের কাছ থেকে শুধু সুখ চেয়ে নেবো, শুধু আনন্দ চেয়ে নেবো, পারতো?
তুমি পারলে আমিও পারবো–
আবদুল খালেক রেখাকে বুকের ভেতরে এনে চোখের ওপর একটা গভীর চুমু দিয়ে বললে, এই কথাটাই আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম রেখা, শুধু এইটুকুই।