ছাত্রীরা যেভাবে আসে, তা তো নিজ চোখেই দেখি রোজ। সাজন-গোজন ঠাটবাট দেখে গা জ্বলে যায়, যেন নাগর ধরতে এসেছে। আমরাও তো কলেজে পড়েছি, পড়তে এসে আবার এতো ঢলাঢলি কিসের!
ঢলাঢলিটা দেখলে কোথায়?
কথা তো বলে না, যেন গায়ে উল্টে পড়ে। তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে মুখে খৈ ফোটে, আবার আমাদের সামনে এলে ভিজে বেড়ালটি, সাত চড়েও রা কাড়তে চাইবে না–
আবদুল খালেক বললে, তোমার দেখায় অনেক ভুল আছে। রেখা। এভাবে দেখো না। এভাবে দেখা উচিত না। যারা এভাবে দ্যাখে, তারা কেবল নিজের মনের শান্তিই চুরমার করে।
কতো শান্তিতে তুমি আমাকে রেখেছো!
সেটা আলাদা ব্যাপার–আবদুল খালেক সাবানের ফেনার ভেতর থেকে বললে, কতো দূর দূর গ্রাম থেকে এরা আসে, কতো কষ্ট করে আসে। কত আশা এদের সামনেই। নিছক ঢলাঢলির জন্যে এত পরিশ্রমের কি কোনো দরকার আছে?
তোমাদের মতো দরদী বন্ধুদের জন্যেই আসে। লেখাপড়া না ছাই! কেন, কমার্সের আবু তালেব ছাত্রীকে বিয়ে করে নি? ঢিঢিক্কার পড়ে নি?
বিয়ে করাটা দোষের?
আমি তোমার সঙ্গে এঁড়ে তর্ক করতে চাই না–রেগে গিয়ে রেখা বললে, মুদিওলা বলে দিয়েছে আর বাকি দিতে পারবে না, এবার থেকে নগদ পয়সা দিয়ে সওদাপাতি এনো—
সে দেখা যাবে—
কোনো কথাই তো তোমার গায়ে লাগে না। একটা ডিম পচা হয়েছিল বলে পাঠিয়েছিলাম, যা-তা কথা বলেছে। মোমেনাকে ধমকে বলেছে, ইচ্ছে হয় নিবি, না। ইচ্ছে হয় না নিবি, বদল-ফদল হবে না। বলে দিস বাকিফাঁকি আর দিতে পারবো না।
আবদুল খালেক বললে, ওদেরই-বা কি দোষ, কম টাকা তো আর পাবে না?
তোমার ইজ্জতে বাধে না? ঘরের মানুষের কথা শুনলেই তো ছ্যাক করে ওঠো। একটা ছোটোলোক মুখে যা আসে তাই বলবে, আর ঘরে বসে বসে তুমি লেজ নাড়বে, তোমার আত্মসম্মান নেই?
কি করবো, ওর সঙ্গে লাঠালাঠি করবো?
সে ক্ষমতা থাকলে তো!
আবদুল খালেক হেসে বললে, হ্যাঁ এটাই হচ্ছে আসল কথা। আমি শুধু পারি, এই মুহূর্তে খুব ছোট্ট করে তোমাকে একটা চুমু খেতে–
কি যে বেহায়ার মতো ক্যাল ক্যাল করে হাসো—
রেখা আর দাঁড়ায় না। পাকাটি চিবাতে চিবাতে উঠোনের ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছিলো টুকু। হ্যাঁচকা টানে তাকে দাঁড় করিয়ে হিড়হিড়িয়ে পুকুরঘাটের দিকে নিয়ে যায়।
অনেকক্ষণ পর আবদুল খালেক দরোজায় দাঁড়িয়ে রেখাকে ডাকলো। রেখা তখন রান্নাঘরে।
বললে, মাধু ও মাধু মাধুরাণী!
কাত হয়ে দরোজায় গলা বাড়ায় রেখা।
তোমার হাত খালি আছে?
মাছ কুটছি। এনেছো তো গুচ্ছের চুনোমাছ। রোজ রোজ এই একই আদিখ্যেতা আমার ভালো লাগে না। কি করে আমাকে জব্দ করবে শুধু এই তালে থাকো। অন্য মাছ না পাও খালি হাতে ফিরবে, রোজ রোজ এই ডোগাড়া মাছ কুটতে কুটতে আমার ঘেন্না ধরে গেছে—
আবদুল খালেক বললে, ইচ্ছে করে কি আর আনি, এই ছোট্ট একটা কালকিনির দাম বারো থেকে চোদ্দ টাকা। টাকা-পয়সা যেন ময়লা। এর চেয়ে ঘাস খেয়ে থাকা ঢের ভালো!
একটু পরে হাত মুছতে মুছতে রেখা এলো। বললে, কি বলছিলে বলো।
ভরসা পাচ্ছি না যে—
আমার কাছে কিন্তু কোনো টাকা-পয়সা নেই, আগে থেকেই বলে রাখছি। যাও ছিল কায়দা করে করে তো তার সবই কুঁকে বসে আছ!
পিঠে একটু তেল মালিশ করে দেবে, গা-হাত-পায় বড়ো ব্যথা, এমন টাটাচ্ছে।
চৌকির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে তেল মালিশ করাতে করাতে আবদুল খালেক বললে, আচ্ছা মাধুরাণী, তোমার হাত এতো মিষ্টি কেন?
ইস!দুম করে একটা কিল দিল রেখা।
আবদুল খালেক বললে, আমি জানি, তোমার হাত দুটো পঞ্চানন ময়রার তৈরি। খাঁটি ছানা আর ভুরভুরে গন্ধ!
রেখা বললে, ইয়ার্কি মারলে আমি কিন্তু মালিশ বন্ধ করে দেবো। গায়ে তো জ্বর–
ওতে কিছু হবে না!
একটু পরে রেখা বললে, আফজাল ভাই বলেছিলো ইস্কুলের পুকুরটার নাকি শিগগির ডাক হবে। তুমি চাইলে আফজাল ভাই তোমাকে সঙ্গে নেবে। কতো টাকারই-বা ব্যাপার! মাছ ছাড়লে ভালো পয়সা পাওয়া যাবে।
দেখি।
তাহলে বলে দাও।
আবদুল খালেক বললে, অসুবিধেটা কি জানো, এইসব টাউটগুলোকে আমার একদম পছন্দ হয় না। জোর করে হিন্দুর সম্পত্তি দখল নিয়েছে লোকটা, তাই দুটো করে খেতে পারছে, তা নাহলে কে পুঁছতো এদের, তোক ভালো না এরা?
তোমার অতো দেখার কি আছে।
আগে দ্যাখো কলেজ টেকে কি না। এখানকার পাটই হয়তো চুকিয়ে দিতে হবে শেষ পর্যন্ত, তুমি তো আর সব কথা জানো না! সামনের মাসে যদি মাইনে পাই, ভাববো বরাতের জোর—ডোনেশনের ওপর কলেজ চলছে। এ্যাফিলিয়েশন হয় নি। টিচার্স বেনিফিট-এর কিছু টাকা তারা পায়। হাবিব ব্যাপারীর ডোনেশন হিসেবে যে মোটা টাকা দেয়ার কথা তা পাওয়া যায় নি।
রেখা বললে, এইসব শুনলে আমার হাত-পা হিম হয়ে আসে। অমন হলে কি করবে?
তখন দেখা যাবে,খামোকা চিন্তা করে কোনো লাভ নেই, আরো জোরে চাপ দাও!
রেখা বললে, তোমার গায়ে সত্যিই জ্বর। আজ আর পানিতে নেমো না। শরীরের দিকে তোমার কোনো নজর নেই!
কোনো কথা না বলে মড়ার মতো নিঃশব্দে কাঠ হয়ে পড়ে রইলো আবদুল খালেক।
কিছুটা পরে রেখা বললে, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি!
না।
চুপ মেরে গেলে যে?
বড়ো আরাম–তুমি আজকাল অমন গুম হয়ে থাকো কেন?
কি বলবো ভেবে পাই না–
কেউ বিশ্বাস করবে একথা?
আর কারো কথা জানি না, তুমি করবে।
অনেক পরে চিৎ হয়ে শুয়ে রেখার একটা হাত বুকের ওপর নিয়ে আবদুল খালেক বললে, আজ থেকে যদি তোমাকে মাধু বলে ডাকি, তুমি কি আপত্তি করবে?