দেবীনাথ জামাইবাবু এক একদিন বেরিয়ে এসে আমাকে দেখতে পেয়ে বলতো, ও তুই, পোকা, আয় না ভিতরে এসে বস্।
কিংবা নিয়ে যেতো ভেতরে। বুড়াদিকে বলতো, আজ না তুমি গুড়ের সন্দেশ তৈরি করেছো, দাও না ওকে—
বুড়াদি কটমট করে জামাইবাবুর দিকে তাকিয়ে বলতো, সে কি আর আছে, সব তো শেষ হয়ে গেছে
কেন তাকের ওপরে যে দেখলাম?
ওতো ঠাকুরের। পুজোয় লাগবে না? তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলতো, তুই সন্ধ্যার পরে আসিস, আমি পুজোটা দিয়ে নিই—
তা দেবীনাথ জামাইবাবুও কম নাছোড়বান্দা নয়। বলতো, এও তো একটা ঠাকুর, তোমার গোপাল ঠাকুর হে! জ্যান্ত পেয়েছ বলে এভাবে ঠকিয়ো না, দাও দাও, তোমার তো লক্ষ্মীর হাত!
বুড়াদির সঙ্গে গেলাম যাত্রায়, মহারাজ হরিশচন্দ্র। সারা গায়ে গহনা পরা কালো রঙের বাঁশি কেঁদে উঠতেই ঐকতান শুরু হয়ে যায়। এমন মন খারাপ হয়ে গেল যে, তা বলবার নয়। দেবীনাথ জামাইবাবু হয়েছিল হরিশচন্দ্র। কালো ধুতি পরে, ছাইকাদা মাখা শরীরে মড়া পোড়াবে বলে শ্মশানে দাঁড়িয়ে। কেউ একজন তার পিঠে লাঠির বাড়ি মারতেই ভীষণ কান্না পেল আমার। বললাম, ওরা অমন মারলো কেন, জামাইবাবু তো আর কোনো দোষ করেনি–
বুড়াদি সে কথায় কান না দিয়ে বললে, ইস্ কি বিচ্ছিরিটাই না দেখাচ্ছে দ্যাখতো! কালি মেখে একেবারে ভূত সেজেছে! কে দেখে বুঝবে গায়ের রঙ অমন টকটকে ফরসা, ইশ!
বললাম, বুড়াদি দ্যাখো, জামাইবাবুকে ওরা আবার মারলো।
বুড়াদি এবার আমার গলা জড়িয়ে কেঁদে ফেললে। বললে, কেন একবার মারলেই তো হয়! ওতো খুব ভালো পার্ট করছে, এইজন্যে হিংসে করে অমনভাবে মারছে। আগে ঘরে গিয়ে নিক, যাত্রা দলে নাম লেখানো বার করে দেবো! ইচ্ছে করে মার খাওয়া—
রাজমুকুট, টিপু সুলতান, মহারাজ নন্দকুমার, আর অনেক পালা চলেছিল। তবে আমার যাওয়া ঐ একদিনই। বুড়াদির সঙ্গে যেতে রানিবুবু। কেবল একদিনই মনি ভাইজান গিয়েছিল। ঘরে ফিরে সে কি রাগারাগি। বললে, ধুৎ বুড়াদির সঙ্গে মানুষ যায়! থির হয়ে বসতে দেবে না কিছুতেই। একবার বলে ও মনি, যা না ভাই, এক দৌড়ে আমার বাসকোর চাবিটা নিয়ে আয়, বিছানার ওপর ফেলে রেখে এসেছি, কতো কিছু রয়েছে বাসকোয়। একবার বলে মনি, যা তো, চুপি চুপি তোর জামাইবাবুকে গিয়ে বলে আয়, মুকুটটা ঠিকমতো বসে নি, কি বিচ্ছিরি দেখাচ্ছো! যতোসব ঝক্কি!
মনি ভাইজান রাগ না করলেও বোধহয় পারতো। বুড়াদির বাচ্চা হবার আগে তো মনি ভাইজান আর কম ছোটাছুটি করে নি! কি খেয়াল হলো, বুড়াদি বললে, দত্তপুকুরে বাবুদের জলপাই বাগান আছে, এনে দিবি? মনি ভাইজান ছুটলো আনতে। একবার দত্তপুকুর, একবার মধ্যম গ্রাম, একবার বিরাটিতে, একবার শুমোয়, এইভাবে ছোটাছুটি করতে মনি ভাইজান। একবার করিমন বিবির গাছ ভেঙে ডালসুদ্ধ পেয়ারা নিয়ে হাজির, বুড়াদি কি খুশি! বললে, আর জন্মে মনি আমার ভাই ছিল। কেন যে ওর এতো মায়া।
টিপু ভাইজান কলকাতার কলেজে ভর্তি হবার পর আমরা সবাই তাকে বেশ সমীহ করে চলতাম। টিপু ভাইজান যখন গোঁজামিল দিয়ে কোনো রকমে দায়সারাগোছের নাকেমুখে কিছু গুঁজে তাড়াহুড়ো বাধিয়ে বলতো, আজ প্রফেসর বটব্যালের ক্লাস আছে, অটল পাহাড়ের মতো মানুষ, সময়মতো না পৌঁছুলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেবে–তখন অবাক হয়ে আমরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
অটল পাহাড়ের মতো মানুষের মুখোমুখি কোনোদিন কি দাঁড়াতে পিরবো, ভয় হতো। কখনো গায়ে হাত তোলেন নি করুণা দিদি মিণি। কোনোদিন কোনো কারণে যদি দেখি তার মুখ কালো ভয়ে হিম হয়ে গেছে শরীর, বুকের ভেতর সে কি দুরু দুরু! এক একদিন নিজেই কেঁদে ফেলতেন। বলতেন, ঠিক আছে কাল থেকে আমি আর আসবো না। তোমরা কেউ আমাকে ভালোবাস না, কেউ মন দিয়ে আমার পড়া কর না, আমি তোমাদের কেউ নই।।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলতাম, হে আল্লা করুণা দিদিমণি যেন কাল ইস্কুলে আসে— যেন এই গতকাল ঘটেছে সবকিছু। যেন এইমাত্র সবাই গলা মিলিয়ে গাইলাম সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান, এইমাত্র হাতে ফুল নিয়ে করুণা দিদিমণি বললেন, বাহু, ভারি চমৎকার! অথচ কতোকাল আগের কথা সেসব। পোকা, ও পোকা, এমন চুপ কেন? বল আরো বল। তোমার আর কি দোষ। পোকা, ও পোকা, এমন কাঁদ কেন? তোমার আর কি দোষ, ভালোবাসার যে এতো দায়ভাগ, তুমি যে তার কিছুই জানতে না কাদো কেন?
০৮. সংসারে মন
রেখা বললে, তুমি এসব কি শুরু করেছে বলোতো? লোকে শুনলে কি বলবে! তুমি কি কোনোদিন সংসারে মন দেবে না?
আবদুল খালেক বললে, সংসারেই তো আছি।
তা আছে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই একে কি থাকা বলে? সারারাত জেগে ঐ সব লিখে কি ফায়দাটা পাচ্ছো তুমি! বন্ধু কি তোমাকে গাছে চড়িয়ে দেবে। কেন তুমি ভূতের বেগার খাটতে যাবে। একটা চিরকেলে বাজে স্বভাব; যখন যেটা মাথায় ঢুকবে কচলে কচলে তাকে তেতো না করে ছাড়বে না।
মালেক রাগ করবে, অনেকদিন থেকে ওকে ঘোরাচ্ছি! না পেলে এবারে মেরে বসবে—
মালেককে নিয়ে থাকলেই হয়, অতো যখন সম্পর্ক!
কিভাবে যে তুমি কথা বলো—
ঘরের বৌয়ের কথা কারোই মিষ্টি লাগে না। সব বুঝি, এখন তোমার একটা প্রেম করার দরকার হয়ে পড়েছে, তা করলেই তো পারো। পেয়ারে ছাত্রী তো আর নেহাত কম নয় তোমার, মনমতো একটাকে বেছে নিলেই হয়।
আবদুল খালেক দাড়ি কামানো থামিয়ে বললে, কাউকেই দেখছি তুমি বাদ দিতে চাও না!