এক একদিন আস্তো প্রমীলা ধাত্রী। সাধারণত বিকেলের দিকেই আসতো বুড়ি। সাদা মড়মড়ে থানেমোড়া প্রমীলা ধাত্রীকে আমরা সবাই ভয় করতাম। সে ছিল ভারি খটটাই মেজাজের। বসে বসে মার সঙ্গে গল্প করতো, আর একটা বড় গ্লাসে করে চা খেত। তার জন্যে একটা আলাদা গ্লাসই ছিলো। আমরা সকলেই ছিলাম তার হাতের। সে জাতে ছিল খ্রীস্টান। প্রতিটি বাড়ির অন্দরমহলের সব খবর ছিলো বুড়ির নখদর্পণে।
তা বড়টি এখন কি করছে?
এবার কলেজে ঢুকলো।
মেজ?
এবার ম্যাট্রিক দেবে—
মেয়েটি?
এই তো নাইনে উঠলো—
ভালো। তা তোমার স্বাস্থ্য কিন্তু দিন দিন কাঠি হয়ে যাচ্ছে মনির মা, দেহের দিক একটু যত্নআত্তি নিও–
মা উত্তর দ্যায়, এই নানারকমের চিন্তা-ভাবনা! পার্টিশান—
সে তো আছেই— প্রমীলা ধাত্রী বললে, এতোগুলো ছেলেমেয়ে পেটে ধরা, তাদের মানুষ করা, এ কি মুখের কথা!
আমরা ধারে-কাছে গেলেই খাঁউ করে উঠতো বুড়ি।
কি চাও এখানে? শুধু গাঁয়ে গাঁয়ে ঘোরা। বেচারির হাড়-মাংস সব এক করে ফেলেছে, যাও, বাইরে যাও, খেলেগে যাও খেললাগে যাও–
কখনো মাকে বললে, মনিটার দিকে একটু খেয়াল কোরো। যেখানেই যাই ওকে দেখি, এতো বেশি দস্যিপনা ভালো নয়। এখন থেকে না আর্টলে পরে পস্তাবে। লেখাপড়ায় কেমন?
পাস তো করে—
প্রমীলা ধাত্রী কিছু একটা চিন্তা করে বলে, ওকে বাইরে কোথাও রেখে পড়াতে পারো না? কোনো কোরোস্টালেও তো দিয়ে দিতে পারো।
ওকে নিয়েই তো আমার যতো ভয়, দস্যু ছেলে, চোখের আড়াল করি কিভাবে?
মায়ের স্নেহ হচ্ছে ডাইনীর স্নেহ, এই করে করে তো তোমরা ওর মাথা খাবে। একদিন দেখবে হুট করে একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসে আছে। এখন কি আর সেই আগের মতো দিনকাল আছে! শক্রতা করেও তো লোকে একটা কিছু বাধিয়ে বসতে পারে। এই তো শুনলাম, সেদিন ঘোষালদের ছেলেটাকে রাস্তায় ফেলে ঠেঙিয়েছে! কি না হতে পারতো এইটা নিয়ে–
দ্রুত একটা পরিবর্তন ঘটছিল চারদিকে। সেসব আমরা কিছু বুঝতাম না। হিন্দু মুসলমানদের দলাদলির কোনো ব্যাপার থেকে বালক সংঘ ভেঙে দু টুকরো হয়েছিল। কাজীপাড়ার একটা দলের সঙ্গে তুমুল মারপিট হলো একবার। তখন চলাচল ছিল মার্টিন ট্রেনের। চলতো ঢিমেতালে। কাজীপাড়ার ছেলেরা চলন্ত মার্টিনে উঠে কোনোরকমে মাথা বাঁচায়। যাওয়ার সময় বলে যায়, এর হিসেব হবে, এক একটা করে লাশ পড়ে থাকবে মাটিতে।
একদিন হরিপদ ঘোষালের সামনে পড়ে গেলাম। আমার পেটে আলতোভাবে ছড়ির ডগা ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করলে, কি হে বালক, তোমাদের বাড়িতে শুনি কাজীপাড়ার মোচোনমানরা দেদার মিটিং করে? তোমার বাবা পাকিস্তান চায় নাকি?
পাকিস্তান কি জানা ছিল না। বুঝতাম না এসব কিছুই। কাজীপাড়া একদিল শার দরগা ঘিরে মুসলমান সমাজের একটা বেড়; সেখানে অন্যকোনো জাতের লোক ছিল না। গরুর গোশত কিনতে হলে ওখানকার হাট ছাড়া আর উপায় ছিল না।
কিছুদিন আগে কিসের যেন একটা ভোটাভুটি গেছে; সেই থেকে দেখতাম আমাদের পাড়া-প্রতিবেশীদের অনেকেই মনমরা, কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে পারি, কিন্তু কি তা বুঝি না।
কিছুই জানতাম না।বুঝতাম না। মাঝে মাঝে আমাদের গ্রামের বাড়ির নিকট আত্মীয়-স্বজনরা এসে ফিসফাস করতো ঠিকই, তখন সকলের মুখেই থাকতো দুশ্চিন্তার ঝুলকালি মাখা ময়লা ছাপ; আব্বা শুধু গম্ভীর মুখে বলতেন দেখা যাক কি হয়—
আমাদের বাইরের ঘরেও মাঝে মাঝে শুনতাম তুলকালাম চলছে। আব্বা, কেনারাম কাকা, দুর্গাদাস বাবু, নির্মল বাবু আরো অনেকেই খুবই শোরগোল তুলে তর্কাতর্কি করতো। আমাদের কানে আসতো কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, জিন্না, জহরলাল, প্যাটেল, সব মনেও নেই।
আমার একটা গজদাঁত বেরিয়েছিল। হরিতাল মোড়ে গিয়ে ধীরেন ডাক্তারের কাছ থেকে পুরোনো দাঁতটাকে ওপড়ানো হয়।
রাতে দুর্গাদাস বাবু আব্বাকে বললেন, ব্যাপারটা কি হলো, আমি থাকতে ছেলেটাকে হেতুড়ের কাছে পাঠানোর মানেটা কি?
ধীরেন কম্পাউন্ডার থেকে ডাক্তার বলে পিছনে সকলেই তাকে হেতুড়ে ধীরেন নামে ডাকতো।
আব্বা বললে, ওসব ওর মা জানে—
দুর্গাদাস বাবু গলা চড়িয়ে বললেন, হেতুড়ে ধীরেনই তোমাদের কাছে বড় হলো, এর আমি ব্যাখ্যা চাই।।
চাঁপাড়ালির মোড়ে ছিল মসজিদ। কাজীপাড়া, ময়না আরো দূর দূর থেকেও অনেকে নামাজ পড়তে আসতো সেখানে। বিশেষ করে ঈদের দিন। সেবার হয়েছে কি,আমরা দল বেধে সকলে মসজিদে যাচ্ছি ঈদের নামাজ পড়তে হঠাৎ একটা ঢিল এসে পড়লো। ঢিলটি পড়লো টিপু ভাইজানের পায়ে। পেছনে কে যেন চেঁচিয়ে বললে, দ্যাখ দ্যাখ, মাথায় লেজওলা লেড়েরা কেমন কপাল ঠুকতে যাচ্ছে।
আব্বা বললে, কোনোদিকে খেয়াল করার দরকার নেই, হাঁটতে থাকো—
তা, আমরা সেইমতোই মাথা নিচু করে কোনোদিকে না তাকিয়ে মসজিদে গিয়েছিলাম।
সে বছরই দুর্গাপূজার সময় চারদিকে যাত্রার ধুম পড়ে যায়। সব শখের দল। কেনারাম কাকা এসে বললেন, পোকা, যাবি নাকি যাত্রা দেখতে? তোদের জামাইবাবু পার্ট করবে–
মা বললে, ও কি আর সারারাত জাগতে পারবে?
কেনারাম কাকা বললে, বুড়ার সঙ্গে থাকবে, জাগতে না পারে ঘুমুবে–
বুড়া কেনারাম কাকার মেয়ে। আর কোনো ছেলেমেয়ে না থাকায় ঘরজামাই রেখেছিলেন কেনারাম কাকা। জামাইবাবুর নাম ছিল দেবীনাথ। মাঝে মাঝে তাকে দেখা যেতো ইস্কুলে মাস্টারি করতে। ঐপর্যন্তই। গান-বাজনা ভালোবাসতো। গান-বাজনা নিয়েই থাকতো। রোজ বিকেলে দেবীনাথ জামাইবাবুর ঘরে গান-বাজনার আসর বসতো নিয়মিত। মাঝে মাঝে উঁকি-ঝুকি মেরে দেখতে গিয়ে আমি বিশ্রীভাবে ধরা পড়ে যেতাম। একটা পোষা তোতাপাখি ছিল জামাইবাবুর। দেখতে পেয়ে দাঁড়ের ওপর থেকে সে চিৎকার জুড়ে সুর করে বলতো, ওমা! দেবী দেবী দেবী! এই দেবী! এই দেবী। এই দেবী! কে দ্যাখো কে দ্যাখো কে দ্যাখো—