মনে পড়লো বেশ কিছুদিন যাবৎ ঠিকই হরিপদ ঘোষালকে বারান্দার ইজি চেয়ারে দেখা যাচ্ছে না, কথাটা কি তাহলে সত্যি!
ক্লাস ফেলে এসেছি, আমি চললাম। ছুটির পর সোজা বাড়ি যাবি— এই বলে মনি ভাইজান চলে যায়।
প্রতিদিনই মনি ভাইজান একটা করে ফুলে মন্ত্র দিয়ে দিত। ফুল পেয়ে খুব খুশি হতেন করুণা দিদিমণি। মন্ত্রের কথা কখনো কাউকে আমি বলি নি, যদি তার গুণ নষ্ট হয়ে যায়!
আরতি, রমা, আশা, শেফালি, মল্লিকা, এক একদিন আমি এদের এক একজনের পাশে বসি। খুব ভাব জমেছিল আমাদের এই কজনের মধ্যে। বৈদ্যনাথও ছিল কিছুদিন। ওর ছিল কানপচার ধাত। ওকে পেছনের বেঞ্চিতে বসতে হতো শেষ পর্যন্ত। পেছনের বেঞ্চিতে বসতো আরো একটি মেয়ে, অর্চনা। অর্চনাই ছিল সব ক্লাসের সকলের চেয়ে বয়েসে বড়। লম্বাও ছিল। অনেকেই আমরা তার কোমর সমান ছিলাম।
তা আমরা ডাকতাম অর্চনাদি। অর্চনাদি একটু হাবা কিসিমেরই ছিল, যতোদূর মনে পড়ে। তার মাথায় উকুনও ছিল। এই জন্যে
কেউ তার কাছাকাছি ঘেঁষতে চাইতো না।
এক একদিন এমন হতো, হয়তো টিফিনের ছুটি, মেঝেতে বসে পা লম্বা করে অর্চনাদি মাথার উকুন খুঁটতে শুরু করেছে, আমাকে দেখে বললে, এখানে বস, তোর নখ দেখি—
আমি নখ বাড়াতে একটা উকুন বসিয়ে দিল তার ওপর। বললে মার। যেন পট করে শব্দ হয়—
এইভাবে পটপট করে উকুন মারতে হতো। কখনো বললে, আমার খাতার মলাটে বৌদি লেখেছে কে রে? মিথ্যে বলবি না। মিথ্যে বললে মা সরস্বতী তোকে ফেল করিয়ে দেবে, বুঝে-শুনে
বলিস—
অর্চনাদিকে নিয়ে নানা রকমের হাসিঠাট্টা চলতো। একদিন আরতি বললে, তোরা জানিস, গতকাল বরের বাড়ি থেকে অর্চনাদিকে নাকি দেখে গেছে!
অর্চনাদি বললে, গতকাল কে বললে তোদের, সে তো গেল মাসে। গণ্ডেপিণ্ডে গিলে তারপর যাবার সময় বললে, গিয়ে খবর দেবো। ঐ পর্যন্তই। কোনো খবর দেয়নি। আমাকে আর কে পছন্দ করবে, আমি তো আর তোদের মতো সুন্দর না ভাই! হাতের সেলাই দেখে যদি কেউ পছন্দ করে!
অর্চনাদি বাড়ি থেকে কৌটোয় ভরে প্রায়ই নিয়ে আসতো নানারকমের টক-মিষ্টি আঁচার। আমরাও ভাগ পেতাম।
টিফিনের ছুটিতে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়তাম আশপাশে। চৌধুরীপাড়ায় মস্ত একটা বাড়ি ছিল, বাড়িটার জানালা-দরোজা কখনো খোলা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। লোকে বলতো সেটা চৌধুরীদের বাড়ি। ফটকের মুখে দুপাশে দুটো পাথরের সিংহ। আমরা যেতাম ইউক্যালিপটাসের সুগন্ধি পাতা কুড়তে। বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে থাকতে পাতাগুলো।
একবার কপালে ফেটিবাঁধা একটা পাগল আমাদের ধরেছিল। বললে, ভীমনাগের সন্দেশ খাবে তোমরা? তাহলে চুপটি করে হাতটি পেতে আসন গেড়ে বসে পড়ো এই ঘাসের ওপর!
আমরা বসে হাত পাততেই সে সকলের হাতে দুটো করে ছোলাভাজা দিয়ে বললে, খাও, খেয়ে দ্যাখো কেমন মিষ্টি!
আমরা বললাম, এ তো ছোলাভাজা!
সে বললে, যাঁহা ছোলাভাজা, তাঁহা সন্দেশ। সন্দেশ পেটে গিয়ে ছোলাভাজা হয়, ছোলাভাজা পেটে গিয়ে সন্দেশ হয়। মোসলমান মরে গেলে হিন্দু হয়, হিন্দু মরে গেলে মোসলমান হয়। পেটই হচ্ছে চিতা, পেটই হচ্ছে কবর; সে হালুম-হলুম গবগবাগব গবগবাগব সব খেয়ে ফেলে, সব হজম করে ফ্যালে। হজমের পর তো সব একই—
দে দৌড় দে দৌড় বলে ভয়ে আমরা যখন ছুটে পালাচ্ছি, পেছন থেকে সে তখন আহ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠেছিল।
আর একবার দেখা হয়েছিল একটা খুনখুনে ছেলেধরা বুড়োর সঙ্গে। তার পিঠে শুকনো পাতা বোঝাই বস্তা। সে আমাদের দেখে বললে, বাছারা জানো আমি কে? ঐ হোথায় কলপুকুরে শেয়ালের গর্তে আমি থাকি। যখন দাঁত ছিল তখন এমনিই জ্যান্ত জ্যান্ত বাচ্চাকাচ্চা ক্যাচম্যাচ করে চিবিয়ে খেতাম। এখন দাকা দাকা করে কেটে একঘটি জলের সঙ্গে টপটপাটপ গিলে খাই। ছাড়ো দেখি কিছু পয়সা, তা নৈলে কিন্তু রেহাই নেই—
কুড়িয়ে বাড়িয়ে সকলের সব পয়সা মিলিয়ে হলো মোট তিন আনা। সেই তিন আনা দিয়ে তবে রেহাই। লোকটা বললে, কুল্লে তিন আনা? কেমন ধারার কথা গো? তা দাও দিকি যা আছে। কাল যে কি কুক্ষণে পাঁচকড়ির ব্যাটা এককড়িকে গিলেছিলাম, সেই থেকে পেটটা কেমন দমসমে হয়ে আছে। নৈলে কি আর একটাকেও ছাড়তাম!
হামব্যায়লায় জামব্যায়লায় ঘাস ক্যামবায় খায় গাইতে গাইতে বুড়োটা একদিকে চলে গিয়েছিল।
এই সময় একটা ঘটনা ঘটে। হঠাৎ শোনা গেল বুড়ি গিরিবালাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। মনি ভাইজান বললে, খামোকা বুড়িকে কষ্ট দিচ্ছে ওরা। ও কি আর কিছু জানে? বুড়ির উঠোনের জঙ্গলের ভেতর চোর-বদমাশেরা নাকি চুরির মালামাল পুঁতে রাখতে, ওখানে বসেই ভাগ-বাটোয়ারা করতো। তা বুড়ি তো ভালো করে চোখেই দ্যাখে না, ও কি জানবে।
ছাড়া পেয়ে কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল বুড়ি। আমাকে ওরা এইভাবে হেনস্তা করলে রে, কেন আমার মরণ হয় না! ও ভগমান, চোখের মাথা খেয়ে বসে আছিস, আমাকে তুলে নে, আমাকে তুলে নে। এইসব বলতো আর সমানে দেয়ালে মাথা কুটতো গিরিবালা!
রমা, আশা, শেফালি, আর আমি একদিন বিকেলে দল বেঁধে গিরিবালার ওখানে গিয়ে দেখি, মনি ভাইজান তার মাথায় পানি ঢালছে। আমাদের দেখে বোধহয় একটু লজ্জাই পেয়েছিল। বললে, কি চাস এখানে, যা ভাগ, ভাগ এখান থেকে–
এক একদিন দল বেঁধে হাতিপুকুরের কাছাকাছি যেতাম, দুপাশে বকুল গাছে ঢাকা একটা লাল সুড়কির রাস্তা ছিল সেখানে ঐ রাস্তারই এক এক পাশে এস.ডি.ও সাহেবের কুঠি, মুনসেফ সাহেবের কুঠি। সারাদিন বকুল ফুলের গন্ধে ভুর ভুর করতো ঐ অঞ্চলটা। ফুল কুড়োনো শেষ করে তারপর যে যার বাড়িতে ফিরে যেতাম।