পেতলের কাজললতার বদলে হাঁচিচাঁচা পোড়া সর দুএকবার ভাগ্যে জুটলেও মাছের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব জমে নি। ও যে কি বলতো, কিংবা সত্যি সত্যিই কিছু বলতো কি না আমি তার বিন্দুবিসর্গও কোনোদিন বুঝে উঠতে পারি নি।
তার মানে, হাবা তো হাবা, বেশ ভালো রকমেরই হাবাগোবা ছিলাম। হাবা আর হেড়েমাথার। আমার মাথাটা একটু বেটপ ধরনের বড়ই ছিল। আমার বড় বোন রানিবুবু আমার মাথায় টু মেরে যখন বলতো কাল সকালেই দেখবি তোর মাথায় দুটো শিং গজিয়েছে—তখন আমার হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে যেতো ভয়ে, আমি হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিতাম।
পায়ে কাঁটা ফুটেছিল, পুঁটি শুনে বললে, বের করতে পেরেছিলি তো সবটুকুন?
বললাম, মনে হলো তো সবটাই—।
না বেরুলে দেখিস কি হয়! দাঁত দিয়ে কিছুক্ষণ নিজের জিভ চুলকে নিয়ে পুঁটি বললে, শেষ পর্যন্ত চোখের মণি ফুটো করে নিজে নিজেই বেরুবে, তখন দেখবি ভোগান্তিটা কেমন—
ভয়ে হাত-পা পড়ে যাবার জোগাড়।
পুঁটি তখন ভরসা দিয়ে বললে, ভয়ের কিছু নেই, কাঁটা তাড়ানোরও মন্ত্র আছে, আগে বল কি দিবি?
ওষুধ মাড়ার একটা খল ছিল ঘরে, শ্বেত পাথরের ছোট্ট নৌকোর মতো; চুপি চুপি সেটাই খুঁজে দিই পুঁটির হাতে। সে তো মহাখুশি। সে যাত্রা কাটার হাত থেকে চোখটাকে এইভাবেই রক্ষা করা গেল।
বারান্দার চকচকে সিড়িতে বসে আঙুল চুষতে চুষতে রাস্তা দেখতাম। অনেক কিছুই আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল দেখতে দেখতে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব গাছ, কিছু কিছু ঘরবাড়ি, অল্পবিস্তর মানুষজন। যেমন ডালপুরিবুড়ো। ছোট্ট চুপড়িতে কচি কলাপাতার বিছানায় ডালপুরি সাজিয়ে দুপুরের পরপরই ডালপুর-হি ডালপুরহি হাঁক ছেড়ে চওড়া রাস্তার ধার ঘেঁষে সে হেঁটে যেতো। বুড়োটার পা জোড়া ছিল দেখবার মতো; ঠিক একজোড়া ধনুক, মনে হতো এক্ষণি মচকে পড়ে যাবে মানুষটা। মাথায় লাল টুকটুকে একটা গামছা রাখতো সে বিড়ে পাকিয়ে। শুনতাম লোকটা জাতে পোদ, কোনো এক সময় সে নাকি রণপায় চেপে ডাকাতি করে বেড়িয়েছে।
মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, শনপাড়িওলার চেহারাও। দুই পাল্লার টিনের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে ঠিক ভরদুপুরে সে হাঁক দিত। চোখে ধরার মতো ছিল তার সাজগোজের বহর। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কালো সিল্কের জামা, কোমরে আর গলায় রুপপার জরির নকশা খেলানো। একটা কানে আবার মাকড়ি। অমন বাবরি চুলও বড় একটা চোখে পড়তো না। শণপাপড়ি আর মিহিদানা একসঙ্গেই বিক্রি হতো।
ছিল কুলপিমালাইওলা, চিনেবাদামওলা, লাল মিঠাইওলা। বাঁশের সাজিতে ধামা কুলো পাখা এইসব মিঠাই সাজানো থাকতো। একহাতে সেই সাজি, আরেক হাতে একটা আমের ডাল, পাতার ফাঁকে ফাঁকে লাল লাল আম আর লিচুর লুকোচুরি, এই হলো লাল মিঠাইওলা।
চিনেবাদামওলার ঝকাও ছিল দেখবার মতো। গাঁদা না হয় জবা, একটা না একটা ফুল দিয়ে সেটা সাজানো থাকবেই, যেন লগনের ঝুড়ি, বাবুয়ানা করে বরবাড়ি থেকে আসছে।
কাছাকাছি কোথাও ছিল গোরা সৈন্যদের ছাউনি। মাঝে মাঝে হুসহাস করে উড়ে যেতো ইয়া ইয়া নাকভোতা ট্রাক, চালাতো নিগ্রোরা।
রাস্তার দিকে পা বাড়ালেই কানমলা খেতে হতো; সুযোগমতো ছোট ছেলেমেয়ে সামনে পেলেই নিগ্রোরা নাক কঁাচম্যাচ করে তাদের চিবিয়ে ফেলে, এইসব শুনতাম। তারা যেসব গাড়ি চালাতে লোকে সেগুলোর নাম দিয়েছিল হুদমো গাড়ি।
আমাদের বাড়ির একপাশে ছিল একটা বুড়ো ঝাউগাছ। গাছটার সারা গায়ে ঠেলে উঠেছিল ডুমো ডুমো কালো গাট। গাটের নিচে ফোকর। ফোকরে জমে থাকতো সুজির মতো কাঠের গুড়ো।
গাছটার মগডালে মাঝে মাঝে শকুন এসে বসতো। একবার কি হলো, হঠাৎ রাস্তার একপাশে জিপগাড়ি থামিয়ে দুমদাম ফায়ার শুরু করলে দুজন গোরা সৈন্য। ফটাফট জ্বালা-দরজা সব বন্ধ হয়ে গেল আমাদের ঘরের, লালমুখো লালমুখো—আমরা তো ভয়ে আধমরা।
পরে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখা গেল, লালমুখোরা উধাও, কেবল রাস্তার একপাশে রজনী ভেণ্ডারের ছেলে পানু তুমুল হাত-পা নেড়ে চাকবাঁধা মানুষজনদের কিছু একটা বোঝাচ্ছে। বেশ বড় রকমের একটা ভিড়, আমাদের উঁচু বারান্দা থেকে পানুকে প্রায় দেখাই যায় না।
পানু একা সাহস করে সাহেবদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বুঝিয়েছিল, ভালচার ভালচার–
সাহেবদের সঙ্গে কঠিন ইংরেজি বলনেওলা লোক দেখা সেই প্রথম আমার। দুম করে হিরো হয়ে গেল পানু।
গুলি খেয়ে একটা শকুন মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, এক খাবলা মাংস উড়ে গিয়েছিল বুকের এক পাশের। এমন জখমের পরও সপ্তাহখানেক বেঁচে ছিল; আমরা কাছাকাছি গেলেই সে ঝটপট করে কোনো রকমে কয়েক হাত দূরে ঝাপিয়ে পড়তো, শুকনো পাতার ডাঁই করে নিজেকে আড়ালে রাখতো। খুব কষ্ট পেয়ে মরেছিল শকুনটা। শেষের দিকে এমনভাবে গলা করে কাঁদতো, মনে হতো মানুষ।
হাইলেচা হাইলেচা, হাইলে হাইলে হাইলেচা–এই ধরনের একটা বিচিত্র গান ফেঁদে বসতো পানু, ভোরবেলা সৈন্যরা যেসব গান গেয়ে গেয়ে দলবেঁধে রাস্তায় দৌড়াতো তারই কিছু একটা নিজের সুবিধেমতো ভেজে নিয়েছিল সে। আমাদের দেখলেই কঠিন কঠিন সব ইংরেজির তুবড়ি ছোটাতো সে, জিনজার মানে আদা, মিনজার মানে মাদা, গিনজার মানে গাঁজা। খুব অবাক হতাম পানুর বিদ্যাবুদ্ধির বহর দেখে। ভীষণ লজ্জা করতো, কতো কিছুই না জানে পানু, এমন ছোট মনে হতো নিজেকে!
ঝুমি একবার আমাকে একটা ভাঙা তেশিরা কাচ দিয়েছিল, সেটার মালিক ছিল পাঁচু। খবরদার, পাঁচু জানতে পারলে কিন্তু কেড়ে নেবে— ঝুমি চুপি চুপি বলেছিল, আমার নাম করবি না কিন্তু কারো কাছে!