বললাম, মারে না?
তা মাঝে-মধ্যে একটু আধটু মারে বৈকি। তবে যারা খুব যত করে পাকা চুল তুলে দ্যায়, তাদের মারে খুব আস্তে করে। মার খাওয়ার কতোগুলো কায়দা আছে। হাত পাততে বললে হাত পাতবি ঠিকই, কিন্তু সপাং সপাং বেত পড়ার আগেই ঝট করে সেটা সরিয়ে নিবি, নিয়েই ওরে বাবাগো, ওরে মাগো, আপনার পায়ে পড়ি স্যার, মরে গেলাম স্যার—এই বলে চিৎকার করে উঠবি, তখন দেখবি স্যার বলবে, ঠিক আছে যাও, ভবিষ্যতে যেন মনে থাকে। আর যদি গাট্টা মারতে যায়, তখন হাত জোড় করে বলবি, মাথায় মারবেন না স্যার, মাথায় মারা নিয়ম নেই, আপনি পিঠে মারুন। এই বলে পিঠ পেতে দিবি। যেই পিঠে বেত পড়বে অমনি হুড়মুড় করে স্যারের গায়ের ওপর পড়ে যাবে, ব্যস্—
বললাম, তোমাকে মারে?
মারে আবার না? তোকেও মারবে। তা সে তেমন কিছু নয়। মার খাওয়ার কায়দা জানতে হয়। কায়দা জানলে মার খাওয়া আর এক গেলাস দুধ খাওয়া সমান কথা। তুই একটা ভিতুর ডিম। আমার কতো রকমের কায়দা আছে! এক একবার এক এক স্যারকে একেবারে অবাক করে দেই। একবার তো মার খেয়ে মরেই গিয়েছিলাম। স্যার যখন কেঁদে ফেললে, তখন বেঁচে উঠে চোখ মোছার জন্যে স্যারকে ব্লটিং পেপার দিয়ে বললাম, ঠিক আছে এবারের মতো বেঁচে উঠলাম, এরপর মারলে কিন্তু আর বাচবো না। স্যার কি করেছিল জানিস? কাউকে না জানিয়ে পঞ্চানন ময়রার দোকানে নিয়ে গিয়ে আমাকে পেটপুরে পান্তুয়া খাইয়েছিল, আর প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল যেন কাউকে না বলি। মারের বদলে পান্তুয়া খাওয়া যায়, বুঝলি, বুদ্ধি খাটাতে হয়–
ভয়ে ভয়ে বললাম, আমি যদি তোমার মতো বুদ্ধি খাটাতে না পারি?
মনি ভাইজান বললে, না পারলে না পারবি, তাতে কি! কতো উপায় আছে! তোকে মন্ত্র শিখিয়ে দেব। হাজার রকমের মন্ত্র আছে। যেমন ধর এই মন্ত্রটা। আগে গেলে বাঘে খায়, পিছনে গেলে সে পায়, শঠে শাঠ্যাং সমাচারেৎ এই বলে তিনবার বুকে ফুঁ দিবি, দেখবি মারতে গিয়েও সে থেমে গেছে, ফিক্ করে হেসে ফেলেছে।
বলতাম, অতো কঠিন কি আমার মনে থাকবে?
প্রাকটিস করতে হবে। ব্রতচারী খেলার কাঠি দুটো নিয়ে খট খট খটাং শব্দ তুলবি, আর মুখস্থ করবি, ব্যস!
কালীকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়, এই ছিল ইস্কুলের নাম। কেনারাম কাকাদের কয়েকজনের উদ্যোগে বোধহয় সে বছরই নতুন বসেছিল ইস্কুলটি। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন কেনারাম কাকাই। চৌধুরীপাড়ার এক বিশাল বাড়িতে ইস্কুল। উঁচু উঁচু ছাদ, মোটা মোটা থাম, চওড়া বারান্দা, ঘোরানো সিঁড়ি, ইস্কুল দেখে বুক টিপ টিপ করে। ভর্তি হয়ে গেলাম ক্লাস টু-তে। টু-তে যে ভর্তি হতে পারবো, এ ব্যাপারে কিছুটা সন্দেহ ছিল। ঘরে ফিরে দেখলাম সকলেই খুশি। আব্বা বললে, এবার ভালো করে লেখাপড়ায় মন দাও পোকা, এখন থেকে তো ইস্কুল।
প্রথমদিন ভর্তি হয়েই খালাস। কেনারাম কাকা বললেন, আজ থাক, একেবারে কাল থেকেই ক্লাসে আসবে।
প্রথম যেদিন ক্লাসে যাই, সেদিনকার কথা আজো মনে আছে। মনি ভাইজান একটা লাল গোলাপ আমার হাতে দিয়ে বললে, ক্লাসে প্রথম যে দিদিমণি আসবে, তাকে দিবি, এ মন্ত্রপড়া গোলাপ, খরবদার, মাটিতে না পড়ে, তোকে মারতে পারবে না।
প্রথম পিরিয়ডে এলেন করুণা দিদিমণি। নাম ডাকার সময় আমিও সকলের মতো বললাম, উপস্থিত! নাম ডাক শেষ হলে ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে গিয়ে ফুলটি দিতেই বললেন, বাহ, খুব সুন্দর!
ইস্কুলে পুরুষ বলতে ছিলেন কেবল বুড়ো হেডস্যার, চিত্তরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। বাদবাকি সকলেই মেয়ে। করুণা দিদিমণি, লাবণ্যপ্রভা দিদিমণি, হেম দিদিমণি, তরু দিদিমণি। ক্লাসেও ছেলেদের সংখ্যা ছিল নামেমাত্র, আসলে স্কুলটাই ছিল মেয়েদের। প্রথমদিকে বলে পড়ুয়াদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্যেই বোধহয় কিছু কিছু ছেলে ভর্তি করা হয়। আমিও সেই একই দলের। আমাদের ক্লাসে আটচল্লিশজন ছাত্রছাত্রীর মাঝে ছেলে বলতে ছিলাম ভোলা বৈদ্যনাথ আর আমি।
টিফিনের সময় দেখি সিঁড়িতে বসে মনি ভাইজান। সর্বক্ষণ কেটেছে ভয়ে ভয়ে এই বুঝি কিছু হয়ে গেল, ধড়ে প্রাণ এলো মনি ভাইজানকে দেখে।
বললে, কিছু হয়েছিলো?
বললাম, না।
কি করে হবে, এ কি যে সে মন্ত্র, দেখলি তো! আমার হাতে মুড়ি-মুড়কি আর কদমার ঠোঙা দিয়ে মনি ভাইজান বললে, মন্ত্রের জোরে আমি যেকোনো লোককে চোখের পলকে একেবারে গরুছাগল-ভেড়া বানিয়ে দিতে পারি, জানিস তুই!
আমাকে হাবার মতো হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? ঐ দ্যাখ-দ্যাখ–এই বলে একটা গরুকে দেখালো। খুব কাছাকাছি গায়ে কালোর ছিটমারা একটা সাদা গরু একমনে ম্যাড় ম্যাড় করে টোঙা চিবাচ্ছিল। বললে, বল তো, ওটা কি? বললাম, একটা গরু!
তোর মাথা। ওটা হচ্ছে হরিপদ ঘোষাল। দ্যাখ না এখনো যুগান্তর কাগজের মায়া ছাড়তে পারে নি। একটা ঠোঙ্গা চিবোচ্ছে, তাও যুগান্তর কাগজের তৈরি। লাগতে আসে আমার সঙ্গে, দিলাম ব্যাটাকে গরু বানিয়ে, এরই নাম মন্ত্রশক্তি!
হরিপদ ঘোষালের ছেলে সুবলের সঙ্গে কি নিয়ে একটা ঝগড়া হয় মনি ভাইজানের, তারপর রাস্তার মাঝখানে ফেলে দে পিটুনি। হরিপদ ঘোষালের কাজ ছিল দুপুরের পর থেকে বাইরের বারান্দায় একটা ইজি চেয়ারে গাছেড়ে দিয়ে সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত খবরের কাগজে ডুবে থাকা। তারই ফাঁকে ফাঁকে লোকটা নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে নিত। সুবলের কান্নাকাটিতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সেদিন। তারপর হাঁকাহাঁকি, চিল্লাচিল্লি, থানা পুলিশ, রাজ্যের হাঙ্গামা।