ভয়ে কেমন যেন হয়ে গেলাম, অসাড় হয়ে এলো হাত-পা। আব্বা, মা, টিপু ভাইজান, মনি ভাইজান, রানিবুবু, সবাইকে মনে হলো হৃদয়হীন, আমার জন্যে কারো এক ফোঁটা দয়ামায়া নেই। কেবলই কান্না আসে, মনে হয় সব শেষ হয়ে গেল, কাল হাত-পা বেঁধে এরা সবাই মিলে আমাকে পুকুরে ফেলে দেবে।
মনে হতো চিরকাল এইটুকুই থাকবো। এইভাবেই থাকবো। কেনারাম কাকার হাত ধরে হাতিপুকুর পাড়ে যাবো, শেঠপুকুরের মাঠে মনি ভাইজান ফুটবল খেলবে, একা পাশে বসে বসে তা দেখব। পাঁচু ঝুমিকে লুকিয়ে চুড়ির শেকল দেবে, ঝুমি পাঁচুকে লুকিয়ে দেবে ভাঙা তেশিরা কাঁচ; সবকিছু ধাপে ধাপে ওঠা, থাককাটা, রঙিন, এইসব দেখবো, বলবো না কাউকে। পুঁটির কাছ থেকে শিখবো পাখিদের ভাষা, তুলিপাখি ফিরে এলে বলবো, আমাদের ছেড়ে কেমন করে তুমি থাকো, তোমার কি কষ্ট হয় না? আমার তো হয়। ঘাটে যখন বসে থাকি, যখন বাগানে যাই, খেতে বসি, তোমার কথা মনে হয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাতে তোমার জন্যে কাঁদি।
মাকে বললাম, আমি ইস্কুলে যাবো না—
তা যাবে কেন, শুধু সকাল-বিকাল-দুপুর টো টো করে গাছতলায় গাছতলায় ঘুরে বেড়াবে। পাখানা যা লম্বা হয়েছে তোমার!
টিপু ভাইজানকে বললাম, আমি তোমার কাছে পড়বো, ইস্কুলে যাবো না–
নিজের পড়া নেই বুঝি আমার! ইস্কুলে না গেলে কি হয় জানিস? ঐ বিন্দের মতো ছায়াবাণীর সামনে বসে বসে পাপর আর তেলেভাজা বেচে খেতে হয়—
মনি ভাইজানকে বললাম, আমি ইস্কুলে যাবো না–
তোর ঘাড় যাবে। মনি ভাইজান বললে, টেনে টেনে কুলোর মতো করে দেবে তোর কান, মাথায় থান ইট দিয়ে একপায়ে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখবে, কান ধরে নীলডাউন হবি, গাট্টা খাবি, মাস্টারদের ফাসকেলাস ফাসকেলাস সব শাস্তি আছে, দেখিসখন। এক একদিন দেখবি এখানে খানিকটা গোশ নেই, পেটের এক থাবলা গোশ হাওয়া হয়ে গেছে, নাড়িভুঁড়ি সব দেখা যাচ্ছে, শোঁ শোঁ করে হাওয়া ঢুকছে আর পটপট করে শব্দ হচ্ছে। যা ভালোবাসে মাস্টাররা কাঁচা গোশ খেতে–
হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আমি বললাম, আমি মরে যাবো, মনি ভাইজান, আমি ঠিক মরে যাবো।
মনি ভাইজান একটা ছিপের সুতোয় বড়শি লাগাতে লাগাতে বললে, মরে যাওয়াতো ভালোই! মরে গেলেই পাখি হয়ে যাবি। পাখি হলে কতো মজা। যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবি। একবার বাঁশঝাড়ে বসবি, একবার আমড়া গাছে বসবি, একবার পেয়ারা গাছে বসবি, যখন যেখানে তোর খুশি। তুই মরলে মাছরাঙা হবি। ঝপাঝপ মাছ ধরবি আর খাবি। মীরজাফর মরে কি পাখি হর্বিছে জানিস, শকুন।
বললাম, শকুন তো অনেক—
তাতে কি–মনি ভাইজান বললে, এক একটা মানুষ মরে গিয়ে এক একটা শকুন হয়েছে। লর্ড ক্লাইভ, জগৎশেঠ, উর্মিচাঁদ, ওয়ারেন হেস্টিংস, নাদির শাহ, তৈমুর লং, ছবির ঠাকুমা মরার পরে ওরা সকলেই তো শকুন হয়েছে।
ছবির ঠাকুমার সঙ্গে মনি ভাইজানের খুব ঠোকাঠুকি হতো। বুড়ির ছিল শুচিবাই। হাঁটতো আর গোবর গোলা পানি ছিটাতো। মনি ভাইজান বলতো, ও বুড়ি, কাল নাকি তোমার বিয়ে? মদনা মুচিকে দেখলাম খুব ঘটা করে সেজেগুঁজে টোপর মাথায় দিয়ে তোমার জন্যে কলপুকুরে বসে আছে!
কলপুকুর এক সময় শুশানখোলা ছিল। কলপুকুরের কথা শুনেই হোক, কিংবা রগচটা স্বভাবের জন্যেই হোক, তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতো বুড়ি, ও নেড়ের ব্যাটা, তোর মাথায় বজ্রাঘাত হোক, তোর ওলাওঠা হোক, তোর কুষ্ঠব্যাধি হোক—
মনি ভাইজান বলতো, এ্যাতো ইংজিরি শিখলে কোতায়? ও বুড়ি, গোবর চচ্চড়িতে আজ হিং দাওনি?
হাতের কাছে যা পেতো তাই ছুঁড়ে মেরে বুড়ি বলতো, ওরে আবাগির ব্যাটা, তোর ধনুষ্টংকার হবে, বাঁদরের মতো খিচে খিচে তুই মরবি।
লুকিয়ে লুকিয়ে গরুর গোশ খাওয়া হয়, জানি না বুঝি–এই বলে দৌড়ে পালাতো মনি ভাইজান।
কুষ্ঠব্যাধি আর ধনুষ্টংকার এই দুটো নাম শুনলেই আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠতো। ধনুষ্টংকার যে কি, বুঝতাম না ঠিকই, কিন্তু দারুণ আতঙ্ক ছিল।
বুড়ি মরে গেলে মনি ভাইজান ছবিদিকে একদিন বলেছিল, আমি কাজীপাড়ার একদিল শাহর দরগায় পাঁচ পয়সা সিন্নি দিয়েছি, বাপরে বাপ, মরতে আর চায় না। ছবিদি কেঁদে ফেলেছিল শুনে। রাগ করে অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে আসেনি।
তারপর মনি ভাইজান বললে, পাখিদের ভেতরে যেমন দেখিস নানা জাতের পাখি, কোনোটা চড়ই, কোনোটা পায়রা, কোনোটা দোয়েল, কোনোটা কাক, মাস্টারদের ভেতরও অমন দেখবি। এক একটা এক এক টাইপের। এক রকমের মাস্টার আছে, তারা কখনও ভাত খায় না। তারা পেট বোঝাই করে শুধু রাগ খায়। এদের ধুতি খুব ময়লা, বড় বড় নখে সবসময় ময়লা লেপ্টে থাকে। দেখবি, এদের টিকিতে খুব সুন্দর সুন্দর গাঁদাফুল ফোটে। এক এক জাতের মাস্টার আছে, তারা দেখতে ঠিক নাদাপেটা গণেশের মতো। শুড়ে পেঁচিয়ে হঠাৎ দেখবি তোকে তুলে নিয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করবে, আজ কি দিয়ে ভাত খেয়েছ? যদি বলিস মাছ দিয়ে, সে অমনি বলবে কি মাছ, পারশে? পারশে মাছে বড় স্বাদ হয়। অতি উপাদেয়। বেগুনের সঙ্গে ভারি চমৎকার জমে। জম্পেস করে খাওয়া যায়। আর এক টাইপের দেখবি, যারা ক্লাসে ঢুকেই বলবে, এ্যাই, এসব কি হচ্ছে এ্যা, বেতিয়ে গায়ের ছাল তুলে নেবো, পেয়েছটা কি, এটা কি গুলতানির জায়গা? তারপর বলবে, নো টক, পিনড্রপ সাইলেন্স, প্রথম বেঞ্চি থেকে শুরু করে রিডিং, এক এক করে সবাই,তারপর দেখবি ভোঁশ ভোঁশ করে নাক ডাকিয়ে সে ঘুমুচ্ছে। এরা এলে ভালোই হয়। ইচ্ছেমতো দারোগা-পুলিশ খেলা যায়, কাটাকুটি খেলা যায়, গল্পের বই পড়া যায়–