রেখা, টুকু, রেখাটুকু—
কেবল এইটুকুই তার সামনে। দৌড়, দৌড়, লম্বা একটা দৌড়, তারপর সে পৌঁছেছে কেবল এইটুকুর সামনে।
রেখা আমার বাড়িতে মানুষ। তার নিজের ভাষায় পরের বাড়িতে। মামীর অবহেলা আর অত্যাচারে তার সমস্ত অতীত ছেঁড়া, টুকরো-টুকরো, ফালা ফালা। নিজের মনকে তাই রঙচটা তালিমারা ছাড়া অন্য কিছু সে ভাবতে পারলো না কোনোদিন।
রেখার ইচ্ছে ছিল মামীকে সে সবকিছু ফেরত দেবে; সব ঋণ–সব দেনা-পাওনা সে একদিন কড়ায়-ক্রান্তিতে শোধ দিয়ে দেবে। তার সব চিন্তা-ভাবনাকে সে এইভাবে ধারালো আর প্রতিশোধ-উন্মুখ। করে তুলেছিল। ফলে বিয়ের পরদিন থেকে এই একটা ব্যাপার আবিষ্কার করা তার পক্ষে অতি সহজ হয়ে পড়ে, যার নাম অক্ষমতা যতোই দিন গেছে, এই অক্ষমতা তার কাছে আরও প্রকট, আরো আরো নিরেট, আরো হীন হয়ে দেখা দিয়েছে। যতোবারই সে পা বাড়াতে গেছে, আশাভঙ্গের যন্ত্রণা তাকে তার নিজের কাছেই ফিরিয়ে দিয়েছে ততোবার। জীবনে এ এক ধরনের মার খাওয়া।
আবদুল খালেক মার খাওয়া রেখার ভেতরের দৈন্যদশার কথা ভেবে কষ্ট পেল। তার নিজের অপরাধও বড় একটা কম নয়, সে জানে। এমন কিছুই নেই তার কাছে জোর গলায় সে যার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। যদি বলা হয় হতোদ্যম, নৈরাশ্যপীড়িত, তারপরও কিছু বাকি থাকে; আজন্মকাল সে মাথা নিচু করে সবকিছু মেনে নেয়ার পক্ষপাতী। এইভাবে মেনে নিতে নিতে আজ সে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
ইচ্ছে ছিল মাকে কাছে রাখার। কোনোদিন সামান্য কোনো আগ্রহ দেখালো না রেখা। কথাটা সোজাসুজি কখনো না তুললেও, হাবেভাবে সবসময়ে সে বুঝিয়ে এসেছে। রেখা হয়তো দ্যাখে-একটা পেট; তার নিজের কাছে একটা প্রাণ। কতো রোগ, কতো শোক, কতো ঝড়বিষ্টিই না গেছে তার ওপর দিয়ে, রেখা তো আর সেসব কিছু দ্যাখেনি।
মাঝে মাঝে সে দুঃখ পেয়েছে, ভেবেছে এতো অনীহা কেন রেখার, এতো অশ্রদ্ধা কেন। ভেতর থেকে ভাঙা, যথাসর্বস্ব খোয়ানো, আর কখনো কারও কাছে যার কোনো দাবি নেই, এমন একটা নিরাপদ মানুষকেও রেখা একদিনের জন্যে ঠাই দিতে পারলো না।
কতো তফাৎ, আবদুল খালেক একটা বৌনাগাছের তলায় দাঁড়িয়ে এই কথা ভাবলো,-মা কি ছিল, আর রেখা কি; মাকে কিভাবে দেখেছে সে, রেখাকে কিভাবে দেখেছে। কাউকে না জানিয়ে,খুব গোপনে, টু-শব্দটি না করে, হাসিমুখে, কি অবিরল নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল মা। সংসারের সামান্য একটা ফাটা পিরিচ, কিংবা ডাঙ ভাঙা কাপ, কিংবা ক্ষয়ধরা পেতলের খুন্তির গায়েও চোখের পানি ছিল মার। এমন কিছুই ছিল না, যার কোনো প্রয়োজন নেই, যা কখনও সংসারের কোনো কাজে লাগবে না। সবকিছু ছিল আদরের। পুরনো পাড় থেকে তোলা সামান্য যে পচা সুতো তারও যে যত ছিল, তাতে জীবনের ভার অনেকখানি লাঘব হয়। তুচ্ছ কুটোগাচা থেকে হাত-বেড়ি-খুন্তিরও অভিমান ছিল, তারাও বোধহয় মা বলে ডাকতে শিখেছিল। মনে হতো অপরাধী, ঘটিবাটির কাছে, ঘরদোরের কাছে, বিছানা-বালিশ-লেপ-তোষকের কাছে। সামান্য যে ফেনফেলা গামলা, হাঁড়িধরা ন্যাতা, ঘরপোছা ন্যাতা, তিল তিল করে সে অপরাধের কথা তাদেরও বোধহয় এক সময় জানা হয়ে যেতো। সেই সে বছর, যে বছর উল্টোপাল্টা খুব ঝড় গেল, পুকুরপাড়ের বাতাবি নেবু গাছটা পড়ে যায়, টিন পড়ে সুকদেবের মার পা কেটে গিয়েছিল, রজনী ভেণ্ডারির অমন জোয়ান মেয়েটা কলেরায় মারা যায়, মনি আমার কোলে এলো–মা বলতো এইভাবে। তা, ও ছেলে তো আমার ধুলোয় ঘোঁটাকেটে মানুষ। না পেয়েছে আদর, না যত্ন। বছর না ঘুরতে কোলে এলো। টিপুর পিঠোপিঠি। কাকে দেখি, কাকে ধরি, একলা মানুষ। একটা গামছা বিড়ে পাকিয়ে মাথার নিচে দিয়ে মেঝেয় শুইয়ে রাখি, একা একা হাত-পা ছুঁড়ে খেলা করে, খিদে পেলে কাঁদে, পেট ভরা থাকলে ঘুমিয়ে থাকে, বড় অবহেলায় মানুষ হয়েছে ছেলেটা–
মার সে বলা ছিল কতো সুন্দর! ও আমার কোলে এলো–একটা গানের কলি। আজ, এই ভরদুপুরে, গরিব বৌনাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে, এক অস্থির আবদুল খালেক, রেখা যাকে তার স্বামী বলে জানে, টুকু যাকে তার আব্বা বলে চেনে, হু হু করে কেঁদে ফেললো। এতোদিন পর, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ঝিরঝির বিপর্যয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো, গাজর ঐ কলিতে ভরদুপুরেও আকাশে চাঁদ ওঠে, সব রোগের নিরাময় ঘটে, সব পাপ ধুয়ে যায়, জগৎ-সংসার ভেসে যায়। কেবলই মনে হয়, কৈ, কোথাও তো কোনো দাগ লেগে নেই!
স্যার, আপনি এখানে? আবদুল খালেকের এক ছাত্র রশিদুল বললে, কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন—
আবদুল খালেক ব্রিত হয়ে বললে, এই একটু দাঁড়িয়েছিলাম। তোমাদের গ্রামগুলো ভারি সুন্দর!
রশিদুল খুশি হয়ে হাত কচলে বললে, চলুন না স্যার একদিন আমাদের বাড়িতে, আপনাকে ঘুরে ঘুরে সব দ্যাখাবো।
তোমাকে নিয়ে একদিন বেরুবো। প্রায়ই ইচ্ছে হয় ঘুরে ঘুরে সব দেখি, হয়ে ওঠে না।
আমাকে আগে থেকে বলে দেবেন। নৌকো ঠিক করে রাখবো–
আবদুল খালেক বললে, এবার ফিরতে হয়।
রশিদুল বললে, আমি বাজার থেকে আসছি। ভাবী আপনাকে ডাকার জন্যে লোক পাঠিয়েছিলেন বাজারে। খুঁজছিল—
তাহলে তো তাড়াতাড়ি ফিরতে হয়।
রশিদুল বললে, আমি কিছুদূর এগিয়ে দেবো, এই রোদে একা একা ফিরবেন–
কোনো দরকার নেই–আবদুল খালেক বললে, তুমি বরং বাড়ি যাও, এ আর কতোটুকু পথ!
ফেরার পথে আবদুল খালেকের কানে বাজে অদ্ভুত একটা বাজনা, জিনজার-গিনজার ট্রসটিন-এম!
০৭. কাল থেকে ইস্কুল
মা বললে, কাল থেকে তোর ইস্কুল। কাল তুই ভর্তি হবি।