আবদুল খালেক নিজেকে আলাদাভাবে দ্যাখে। কারো সঙ্গেই তার কোনো রকমের অবনিবনা নেই। না থাকুক, তবু সে এদের একজন নিজেকে ভাবতে পারে না। বিরাট একটা ফাঁক, সে জানে না সে কখনও পার হতে পারবে না।
তা ইচ্ছে নেই এখন ঘরে ফেরার। ক্রমশ বুঝতে পারে, শুধু যে ঘরে তা নয়, কোথাও ফেরার তার ইচ্ছে নেই। এমনকি তার কোনো ইচ্ছাই নেই।
বাজারে বের হবার আগে একটা অদ্ভুত ব্যাপার তার চোখে পড়েছিল। সে জানতো না বলে হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়েছিল। ভেতরে থেকে দরোজাটাকে নিছক ঠেলে না দিয়ে খিল আটকানো উচিত ছিল রেখার। সে তখন শাড়ি বদলাচ্ছিল। এই ধরনের অমনোযোগিতা খুবই অপছন্দের। না কি নিছক অবহেলা, নিজের প্রতি অবহেলা।
অস্বচ্ছ হলেও, এইসব ব্যাপারে তার একটা ধারণা আছে, সব মেয়েরাই এমন অসাবধানী নয়।
ট্রাসটিন-এম, নামটা ভারি সুন্দর।
ডায়াল-এম ফর মার্ডার, এ্যালান পোর একটি গল্প। ফ্রান্টম অব দি রু্য মর্গ, সে ছবি দেখেছিল মুকুলে। একে একে অনেক ছবি আর বইয়ের কথা তা মনে পড়ে। এই অজ পাড়াগাঁয়ে দেখতে না দেখতে সে ভোঁতা মেরে গেল। কেমন একটু নুদির ভাব দেখতে পাচ্ছে পেটে। একজন নাদাপেট প্রফেসর গদাই লস্করে চালে চপর চপর পান চিবাতে চিবাতে বগলে একখানা বই নিয়ে চর্যাপদের ক্লাস নিতে যাচ্ছে, এই যদি হয় দুবছর পরের ছবি, তা কেমন হবে দেখতে।
দুবছর অনেক দূর। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বলেছিলেন, কলেজ উঠিয়ে দিয়ে ওটাকে একটা কোল্ড স্টোরেজ করে দিলে কেমন হয়!
তা উঠে গেলেই এক রকম ভালো। ঝক্কি চুকে যায়। পকেটে সিগ্রেটের প্যাকেট ঠেলে বেরুনো একরাশ ভ্যাদামার্কা ছেলে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এখন সেও হাঁপিয়ে পড়েছে। ছাত্র হলেও এদের অনেকেই পার্টটাইম ব্যবসায়ী, কেউ কেউ বিবাহিত, কারো কারো বয়সে কোনো গাছপাথর নেই। এছাড়াও কতো রকমের যে দুশ্চিন্তা। হাঁড়ির জিওল মাছের মতো অবস্থা, এই আছে এই নেই।
রেখা আর টুকু, এই দুজনের জন্যে তার ভাবনা। নিজেকে সে বাদ দেয়; নিজেকে নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই, কোনো না কোনোভাবে তার চলে যাবে।
এটাও একটা বাতুল চিন্তা ফালতু ধারণী। আবদুল খালেক শুধরে নেয় নিজেকে, তার ভাবনা-চিন্তায় ওদের ভূমিকা যেন নিছক বোঝার। এর ভেতরে আচ্ছন্নভাবে তার একটা অহমিকা আছে, সে চালাচ্ছে ওদের। কে ফাঁদের চালায়, আসলে তো যে যার নিজের জীবনকে নিজেই চালায়। চালানো মানে জীবনকে কোনোরকমে টেনে বেড়ানো। চেয়ে-চিন্তে, মেরে-কেটে, যেভাবেই হোক।
পায়ে পায়ে কাঁঠালতলির দিকে হাঁটতে থাকে আবদুল খালেক; উদ্দেশ্যহীন। দুএকটি ছাত্রের সঙ্গে দেখা হয়। স্যার কোথায় চললেন? জিজ্ঞেস করে কেউ কেউ। যাই দেখি— এর বেশি আর কিছু তার বলার দরকার হয় না।
একটা বিশাল অশথ গাছ আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে। কোনোরকমে সে ডিঙিয়ে গেল। প্রথমে অবাক হলো। বিনা বিষ্টিবাদলাতেই এমনভাবে গাছ-গাছড়ার হুমড়ি খেয়ে পড়া সে আর কখনও দ্যাখেনি। খেয়াল করে দেখলো, গাছের গোড়াটা একেবারে ভোঁতা, শেকড়-বাকড় নেই। ক্ষয়া, পোকা খাওয়া। এই ভেবে কিছুটা অবাকও হলো, এতোদিন তাহলে গাছটা খাড়া দাড়িয়ে ছিল কিভাবেনিছক অভ্যাসবশত? না কি কোনো কিছুর অপেক্ষায়? এ পথে যতোবারই এসেছে, চোখে পড়েছে গাছটা; কেমন যেন ছন্নছাড়া চেহারা ছিল। মনমরা মনমরা। অনেক আগেই তার দিন শেষ হয়ে এসেছিল, এখন বুঝতে পারে, অনেক আগেই।।
দুপাশে ধানখেত, থৈ থৈ করছে বর্ষার পানি; হাঁসের খলবলে একটা বহর ডোবাডুবি শেষ করে খেতের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। আবদুল খালেকের ইচ্ছে কোথাও দু দণ্ড বসার। বাছাবাছির কিছু নেই, বসে পড়লেই হয়, ভয় ছাত্রদের নিয়ে। হাঁটাপথের একপাশে তাকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে মাথামুণ্ডুহীন কতো কথাই তো তারা ছড়াতে পারে।
কোথাও কোনো আড়াল নেই। খুঁজলে পেয়ে যেতে পারে সুবিধেমতো একটা জায়গা। কিন্তু বেশি একটা আগ্রহও তার নেই, এমন নয় যে, সে হই হই করে বেরিয়েছে দিগ্বিজয়ে।
এই বর্ষা কালটা ভারি সুন্দর। প্রতি বছর চার পাশের কয়েকটা নদী পাল্লা দিয়ে ছাপিয়ে ওঠে। তারপর লোকচক্ষুকে প্রায় ফাঁকি দিয়ে আস্তে আস্তে ঢোকে গ্রামের ভেতর। এ গ্রাম, ও গ্রাম, এপাড়া, ওপাড়া, এই করতে করতে পুরো দেশটাকেই তারা ঢেকে দেয়। রুখু রুখু চেহারার গ্রামগুলো বন্য লাবণ্যে মায়াময় হয়ে ওঠে।
আবদুল খালেকের মনে হয় এর আগে কোনোদিন সে এতো মনোযোগ দিয়ে এসব দ্যাখেনি। আধবোজা চোখে অলস ঘুমের ভেতর তার দিন কেটেছে। এক একটা লোকের চেহারার দিকে তাকিয়ে এখন তার মনে হয়, এরা জীবনের মুখোমুখি দাঁড়ানো মানুষ। হয়তো ক্লান্ত, ধসনামা, তবু অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছে।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পাকার করেছে নিজের জীবনকে। কালঘুম। চেষ্টা করলেও এখন আর দেহের জড় ভাঙে না। পাথরের মতো নিরেট,কি অনড় এই মর্মান্তিক অবসন্নতা!
একটা মাছরাঙা গলাপানিতে নামা হিজলের ডালে গিয়ে বসলো। এটা একটা সম্পর্ক, এই মুহূর্তে আবদুল খালেকের তাই মনে হয়,অলিখিত—তবু যুগ যুগ ধরে এইভাবে চলে আসছে সবকিছু। না বসলেও চলে মাছরাঙার, একটা আধডোবা খাড়া কঞ্চির ওপর গিয়ে বসলেও তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। তবু হিজলের একটা শাখা,গোছা গোছা পাতার মনোরম একটা আড়াল সে যখন বেছে নেয়, তখন এক ধরনের নির্ভরশীলতা সত্য হয়ে ওঠে। বড় ক্ষণিকের এ সম্পর্ক, তবু দিব্যকান্তি।