আবদুল খালেক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে বললে, হেপাটাইটিস, মানে যকৃতের ব্যাপার, প্রদাহের ব্যাপার, কি বুঝলেন! তাও আবার কিনা কনজেনিট্যাল, সারাতে সময় লাগবে না?
রুগীটি বেরিয়ে যেতেই ইমান আলিকে দেখা গেল সামনে দাঁড়িয়ে। ইমান আলি ইউনিয়ন পরিষদের ইলেকশনে চেয়াম্যান পদের জন্য দাঁড়িয়েছিল, জিততে পারেনি।
নরহরি ডাক্তার বললে, এই ডে ঢোলমার্কা ফেলুপট্টি, ভিতরে আসা হোক, ভিতরে আসা হোক!
ইমান আলি বললে, খবরটবর কি ডাক্তারবাবু!
আমদের আর খবর! দিন তো এখন তোমাদের।
ইমান আলি আবদুল খালেকের দিকে তার স্টার সিগ্রেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললে, শুনলেন তো স্যার, ডাক্তারবাবুর কথা?
নরহরি ডাক্তার বললে, উনি কি বলবেন, জানেনটা কি উনি! যে টাকা ঢেলেছিল ইলেকশানে, তার দ্বিগুণ-চতুগুণ ঘরে আসছে, খেলা কথা আর কি! আলুর দাম কতোয় উঠেছে, খেয়াল আছে?
ইমান আলি বললে, তাই বলুন!
বলবো আবার কি, এখনো সত্তরে গিয়ে থমকে আছে, শেষ পর্যন্ত ওই আশিতে গিয়ে ঠেকবে, তোমাদের আর পায় কে! তা ছেড়ে দিয়েছ নাকি আলু?
ইমান আলি বললে, পাঁচশো মণের মতো, এখন এই পর্যন্তই!
প্রফেসর কি বুঝলেন? নরহরি ডাক্তার বললে, কেসটা বুঝলেন। মরলো কারা, বেচারা চাষীরা। একে তো বিষ্টিতে সব পচে নষ্ট হলো, তারপর দাম পেল মোটে তিরিশ টাকা। ওতে কোনোমতে খরচও ওঠে না, লাভ তো দূরের কথা। ওদিকে কর্তারা টাউনে বসে বসে স্বপ্ন দেখছেন গ্রামভিত্তিক অর্থনীতির, কৃষককে বাঁচাতে হবে, ভ্যারেণ্ডা ভাজতে হবে, সব বোগাস!
ইমান আলি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললে, স্যারকে তো বলেছিলাম, কিছু আলু ধরে রাখুন, বেধে গেলেও যেতে পারে, তখন শুনলেন না—
আবদুল খালেক বললে, রাখবো যে তেমন সামর্থ্য কোথায়! আমার কিভাবে চলে ডাক্তারবাবু ভালো করেই জানেন!
আপনার কোনো ঝামেলা পোহাতে হতো না— ইমান আলি বললে, আমার আলুর সঙ্গেই স্টোরেজে উঠতো,মধ্যে থেকে ঘরে বসে কিছু টাকা ফাও এসে যেতো আপনার হাতে–
নরহরি ডাক্তার বললে, কাজের কথায় এসো, কলেজের তো চাট্টিবাট্টি গোল অবস্থা! তোমরা কোনো উদ্যোগ-ব্যবস্থা নেবে, না এইভাবে ধুকে ধুকে ওষুধপথ্যের অভাবে চোখের সামনে কলেজটা পটল তুলবে—
ইমান আলি বললে, মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন!
কেন, কি এমন খারাপ কথাটা বললাম! তোমাদের কি কিছুই করবার নেই? ইলেকশনে দাঁড়াবে, আবার অভিমানও করবে, টিকতে পারবে ভিলেজ পলিটিক্সে?
লোকে যাকে চায় না, তার আবার কিসের দায়দায়িত্ব?
দায়িত্বটা তারই–নরহরি ডাক্তার বললে, পলিটিক্সে আগে মার খেতে হয়, বুঝলে দাদা! গভর্নিং বডির মিটিং, কিছু খুচরো প্ল্যান-প্রোগ্রাম, আর লোক দেখানো ছোটাছুটি, এখনকার চেয়ারম্যানের দৌড় তো এ্যাদ্দুর। তোমারই উচিত কিছু করে দ্যাখানো। বড় বড় পার্টি সব ঢাকায় বসে থাকে। তারা মুততেও কখনও গ্রামে আসে না। তাদের সঙ্গে যারা যোগাযোগ রাখে, তারাই তাদের কাছের মানুষ। তাদের কাছে দৌড়বে, তাদের বোঝাবে, খুব কঠিন একটা ব্যাপার না–
ইমান আলি পা দোলাতে দোলাতে বললে, আগে দেখি, আমাদের চেয়ারম্যানসাব কি করে, তারপর ময়দানে নামবো—
নরহরি ডাক্তার বললে, চেয়ারম্যানের চেষ্টা-তদবিরেই রাস্তা আর ব্রিজের কাজকম্মো রমিজ মুন্সী পেয়েছিল, কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে রমিজ মুন্সী আর সিও ডেভের ভেতর নটখট বেধে গেছে। বাইরে রটেছে কলকাঠিটা তোমার নাড়া—
অমন অনেক কথাই রটে। একটা কাজ সেরে আসি। আপনি থাকবেন— এই বলে উঠে যায় ইমান আলি।
ইমান আলি বেরিয়ে যাবার পর নরহরি ডাক্তার বললে, কেমন একটা ডোজ দিলাম দেখলেন তো? ডোজটা ধরেছে মনে হলো। এখন আপনাদের কপাল—
আবদুল খালেক গায়ের জড় ভেঙে বললে, টুকুর মায়ের শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছে–
কি রকম?
এই অসময়ে আর কি–
আগে হয়েছে আর, না এই প্রথম?
আগেও হয়েছে মাঝে মাঝে। এতোদিন কিছু বলেনি। এবারই বললে–
নরহরি ডাক্তার বললে, মেয়েদের ধরনটাই অমন। রোগটাকে পাকিয়ে ফেলে তারপর বলা। খুব বেশি কি?
তাই তো বলছে—
পিরিয়ড গেছে কতোদিন আগে?
এই দিন পনেরো আগে!
একটা স্লিপ টেনে খচ খচ করে ওষুধের নাম লিখে আবদুল খালেকের দিকে বাড়িয়ে দেয় নরহরি ডাক্তার। বললে, যাওয়ার পথে এটা নিয়ে যাবেন, আমার কাছ নেই, ট্রসটিন-এম। ঘরে ফেরার পথে ফুড়ে দিয়ে যাবোক্ষণ–
স্লিপটা হাতে নিয়ে আবদুল খালেক বললে, কোনোদিকে বেরুবেন নাকি ডাক্তার একদিন না বললেন বেড়াতে বেরুবেন—
ফুরসৎ কই! গেলে আপনাকে বলবো!
আবদুল খালেক বললে, এখানে আর মন বসতে চাচ্ছে না, কি করি বলুন তো? সময় যেন আর কাটে না—
সেদিন যেন বলছিলেন রাতে ঘুমের খুব ডিসটার্ব হয়?
ঘুম হয় আমি ইচ্ছে করেই জেগে থাকি। ঐ সময়টা আমার ভালো লাগে–
বেশ রোমান্টিক লোক আপনি—
নরহরি ডাক্তারের ওখান থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই বাজারের মুখে ওষুধের বড় দোকানটা দেখে তার মনে পড়লো, তার কাছে একটা স্লিপ আছে। স্লিপটা এগিয়ে দিল সে। ট্রসটিন-এম নেই। একবার ভাবলো, গিয়ে বলে। কিন্তু ইচ্ছা হলো না। যাক, পরে হবে। সে হাঁটা শুরু করে। কোথায় যাবে এখন! তার ইচ্ছে নেই এখন ঘরে ফেরার।।
এক হয় হোস্টেলের দিকে হাঁটা। আজ বন্ধের দিন। ইচ্ছে করে। আবদুল খালেক জানে ওখানে এখন ধুমসে কাচ্চু কি হাইড্রোজেনের আসর বসেছে। সে নিজে শিক্ষক, কিন্তু তাস পেটানো সহযোগীদের কাউকেই তার তেমন ভালো লাগে না। এরা কেউ কিছু শেখেনি, এদের কারো চোখ নেই, মন বলে কোনো পদার্থ নেই, কোনোমতে একটা ভঁজকরা ডিগ্রী বগলে পুরে মাছির মতো চাক বেঁধেছে এখানে; এই রকমই তার ধারণা। এরা স্কুল, পরশ্রীকাতর, লোভী, অসৎ।