মা বলতো, তুমি কাজে মন দাও, ঘরে মন দাও—
ঘরে বড়ো অশান্তি মা!
ঐ মাধু মাধু করেই তুমি মরবে—
একথা বলছেন কেন মা! কি দিয়েছি আমি তাকে। এই আপনার পা ছুঁয়ে বলছি ও আমার এক পয়সাও নেয় না। উল্টো নিজের কাছে দু-এক টাকা যা থাকে দরকারের সময় তাই দিয়ে দেয়। দুঃখী মানুষের খারাপটাই শুধু দ্যাখে লোকে, আমি তো জানি— এই বলে একদিন কেঁদে ফেলেছিল নগেন স্যাকরা।
বসে বসে বিকেল পার করে দিত। শেষে মাকে বলতে হতো, নগেন এবার তুমি যাও–
প্রতিবার যাবার সময় পাঁচটা টাকা করে নিয়ে যেতো সে। সেই যে গেল, তারপর যথারীতি আর নামগন্ধ নেই আসার। আবার হাঁটাহাঁটি করতে হতো, তাগাদার পর তাগাদা শুরু হতো, শেষে সেই একই নিয়মে ঝট করে একদিন এসে হাজির। প্রায় প্রতিবারই ওঠার সময় সে বলতো, আমার কাপটা কিন্তু আলাদা করে রাখবেন মা, রাজরোগের ব্যাপার! এই বলে সে হাসতো। অদ্ভুত একটা হাসি। এ ব্যাপারে আমরা সতর্কই ছিলাম। গা ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেলে পুকুরে ডুব দিয়ে আসতে হতো মনি ভাইজানকে।
একদিন বিকেলে শেঠ পুকুরের মাঠে মনি ভাইজানরা ফুটবল খেলছে আর আমি বসে বসে তা দেখছি। পেছনদিক থেকে সাদা থান পরা একজন হেঁটে গেল, কাপড়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে সে যাচ্ছে। মনে হলো এ আর কেউ নয়, মাধু।
হাত নেড়ে ইশরা করলাম মনি ভাইজানকে। হাঁপাতে হাঁপাতে একদৌড়ে কাছে এস বললে, কিরে?
মাধু কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে–
কেন?
ঐ তো, দ্যাখো না—
মনি ভাইজান চেঁচিয়ে বললে, মাধু, ও মাধু, দাঁড়াও!
মাধুও দাঁড়াতে আমরা দুজন তার কাছে গেলাম। মনি ভাইজান বললে, কি হয়েছে তোমার, কাঁদছো কেন?
ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল মাধু। কাঁদতে কাঁদতে তার গলা ভেঙে গিয়েছিল। বললে কতো মানুষের কাছে গেলাম, কেউ কিছু দিল না, সবাই দুর দুর করে তাড়িয়ে দ্যায়। আমি কার কাছে যাবো খোকা দাদাবাবু
মনি ভাইজান বললে, কেন হয়েছে কি?
মানষুটা মরে যাচ্ছে—
ঘরের দোরেই তো হাসপাতাল, ধরে বেঁধে পাঠিয়ে দিতে পারলে সেখানে?
যেতে যে চায় না, কতো করে তো বলছি! বলছি যাও, নিজের ছেলেমেয়েদের কাছে যাও, তা যাবে না। বেশি দেরি নেই, হয়ে এসেছে, মাধু আমার এখানেই বরাদ্দ— ডুকরে কেঁদে উঠে মাধু বললে, মুখে শুধু এই কথা। হাত ধরে কাঁদে আর বলে, কিছু করতে পারলাম না। ইচ্ছে ছিল! আমি কি কিছু চেয়েছি! বুক ফেটে যায়, ও বাবাগো——
মাটির ওপরে বসে পড়লো মাধু, মনে হলো এইবার সে মরে যাবে। মনি ভাইজান নাক টিপে ধরলে হাঁ করে সে আকাশের দিকে মুখ তুলে দম নিলো।
মরবে তো! মনি ভাইজান বললে, নোড়ো না এখান থেকে, যাবো আর আসবো। তারপর এক দৌড়ে অদৃশ্য।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে এসেছিলো টাকা নিয়ে। খুব সম্ভব পাঁচ টাকা। আমাকে বলেছিল, খবরুদার, মাকে বলবি না পোকা, কাউকে না। কাল যদি ডিম-পরোটা হয়, আমার ভাগের থেকে আস্ত ডিমটাই তোকে দিয়ে দেব–
বলিনি। পরদিন ডিম হয়েছিল কিনা মনে নেই, তবে টাকার কথা কাউকে বলিনি। এখনো মনে আছে সে কান্নার কথা। অমন কান্না আর কাউকে কখনো কাঁদতে দেখিনি। মাধুর ভালো নাম ছিলো মাধুরী। মাধুর ভেতর থেকে বোধহয় মাধুরীই কেঁদে উঠেছিল সেদিন অমন করে।
০৬. এই যে প্রফেসর
এই যে প্রফেসর, দেখা নেই যে?
আবদুল খালেক বললে, গত সন্ধ্যায় আপনি বসেন নি, আমি এসে ফিরে গিয়েছিলাম, দেখলাম বন্ধ।
নরহরি ডাক্তার বললে, বলেছিলাম। সন্ধে দিয়েই আবার বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কল ছিল। তা আপনি তো জানেনই। সেই যে। ক্রিমিন্যাল এ্যাবরশন কেসটা! বেশ কাজ হচ্ছিলো মেথারজিনে। গতকাল হঠাৎ দারুণভাবে ফল করলে টেমপারেচার। স্যালাইন ট্রানফিউশনের ব্যবস্থা করলাম। কোনো লাভ হলো না, মাঝরাতের দিকে টেঁসে গেল রুগী। চা খান। তা আপনাদের সব খবরাবখবর কি? কলেজের এ্যাফিলিয়েশনের কদ্দূর কি হলো? প্রিন্সিপ্যাল সাহেব ঢাকা থেকে ফিরেছেন দেখলাম। সকালে পুকুরঘাটে বসে বসে দাঁত ব্রাশ করছিলেন—
আবদুল খালেক স্বললে, খবর খুব খারাপ। এ্যাফিলিয়েশনের এখন আর কোনো আশা নেই, সেই রকমই তো বললেন।
বলেন কি?
এদিকে কলেজের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন, যেকোন সময় দপ্ করে নিভে যেতে পারে। এ বছরে পাসের হারটা কি ছিল, ছাত্র আসবে কোথেকে!
তা বটে—
গত বছরে মোটামুটি শদেড়েক নতুন ছাত্র ভর্তি হয়েছিল। এ বছরে গোটা নয়েক, শেষ পর্যন্ত হয়তো জোরজার করে টেনেটুনে জন পনেরোয় উঠবে, এই তো অবস্থা। খুববেশি হলে আর মাস দুয়েক, তারপরে টিচারদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে!
নরহরি ডাক্তার বললে, আপনাদেরও কুড়েমি কি কম? সব কাজের একটা সময় আছে। সময়মতো চেষ্টা তদবিরটাই হলো বড় কথা। নতুন এ্যাফিলিয়েশন যেই বন্ধ করে দেবার কথা উঠেছে, অমনি আপনাদের ছোটাছুটি শুরু। কি দরকার ছিলো পুকুরটাকে ডাকে দেবার, কলেজ নিজের হাতেই তো রাখতে পারতো, মাছ ছাড়তে পারতো, কতকগুলো টাউটকে খুশি করা, এই তত? তা এখন সেই টাউটগুলোকে বলুন, বলুন কিছু ডোনার যোগাড় করে দাও——
আবদুল খালেক বললে, পরিষ্কার বুঝতে পারছি এখানকার পাট তুলে দেবার দিন এসে গেছে!
চেষ্টা-ফেষ্টা করছেন নাকি অন্য চাকরির?
কোথায় চেষ্টা করব, সে সোর্সও নেই, উদ্যমও নেই। তা, যা হবার একটা হয়ে যাক। তখন দেখা যাবে। এইসব নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলে ভীষণ ভেঙে পড়ি।
এক ফাঁকে একটা রুগী এসে বসেছিল। মাঝে মাঝে কাত হয়ে তার মুখের কাছে কান নিচ্ছিল নরহরি ডাক্তার। তারপর আবার সোজা হয়ে আবদুল খালেকের কথা শুনছিল। এক সময় ধমক মেরে উঠলো। অতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছ কেন ছেলে ছেলে করে, ভাইডালিনটা চলুক না, আমি কি ভেল্কি জানি যে, রাতারাতি ভালো করে দেব?