তখন মনি ভাইজান জিগ্যেস করতো, তোমার হাসিটা কোথাকার?
চন্দননগরের! রঙটা ভালো তবে তেমন টিকসই নয়, অনেকবার ফেঁসে গেছে। কি আর করি, নদীয়ার শালকরদের কাছ থেকে হাতেপায়ে ধরে আবার রিফু করিয়ে নিতে হয়েছে। ঐ হাসিটা আছে বলেই দুটো করে খাচ্ছি–
একবার জমাতালি মাকে বললে, বুবুজি, দোয়া করবেন, আমাদের মেয়ের বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে–
মা বললে, কোন্ মেয়ে?
মেয়ে তো আমার একটাই। তা ভালোই। ভিটেমাটি। ভিটেমাটি আছে। চেনাজানা ছেলে। দূর সম্পর্কে ভাইপো। বড় চিন্তা ছিল বুবুজি, ছবিরন আমার মা-মরা মেয়ে–
একটা পেতলের ঘড়া দিয়েছিল মা, এটা তোমার মেয়ের জন্যে নিয়ে যেও।
হাটখোলা পার হয়ে দক্ষিণ পাড়ার দিকে যাবার পথে পড়তো নগেন স্যাকরার দোকান। সময়ে অসময়ে কতো যে হাঁটাহাঁটি করতে হয়েছে ওই পথে। আমাদের বাড়ির সব সোনারূপোর গহনাই নগেন স্যাকরার বানানো। হয় টাকা, না হয় পুরোনো গহনা ঘর থেকে দেয়া হতো। প্রতিবারই সে টাকা ভেঙে বসে থাকতো। মনি ভাইজান আর আমাকে যেতে হতো তাগাদায়। গেলেই বলতো, মাকে বোললা, কালকেই আমি যাচ্ছি!
তার সে কাল বড় সহজে আর আসতো না। বেশিরভাগ সময়ই তাকে পাওয়া যেতো না, এমনিতেও তার যক্ষ্মারোগ ছিল। আব্বাকে না জানিয়ে মা এইসব তৈরি করাতো বলে কোনোরকমের উচ্চবাচ্য হতো না। সাধারণত আব্বা অফিসে চলে যাবার পর মা বলতো, ও মনি, বিকেলে একবার নগেন স্যাকরার কাছে যাস বাবা–
নগেন স্যাকরার বৌ-ছেলে-মেয়ে সবই ছিল। বাড়িতে গেলে তার বৌ গুষ্ঠি উদ্ধার করতো তার নাম ধরে। বলতো, কবেই বা সে বাড়িতে ছিল। দ্যাখোগে, হাটখোলায় সেই খুঁটেকুড়নি মাগীর আঁচল ধরে নির্ঘাত পড়ে আছে। এতে রক্ত ওঠে, তবু মরেও না। মরলে আমার হাড়ে বাতাস লাগতো।
শেষে হাটখোলায় মাধুর ঘরে তাকে পাওয়া যেতো। মাধু ছিল বিধবা। হাটখোলার ঘানিগাছ, বিস্কুটের তুন্দুর, আইসক্রিম ফ্যাক্টরি আর কামারশালার পিছনে একটা একচালা মাটির ঘরে সে থাকতো। বিশাল বিশাল দুটি বটগাছ পেছনে রেখে, গুচ্ছের আশ শ্যাওড়া চাকুন্দে বনমুলো কাঁটানটে আর বিড়ালহাঁচি শেকুলকাটার বন পার হয়ে, তবে সেখানে যেতে হতো।
মাধুর কেউ ছিল না। কখনো অন্য কাউকে সেখানে দেখিনি। বাড়ি-বাড়িতে সে খুঁটে আর গুল দিয়ে বেড়াতে। হাসলে তার গালে টোল পড়তো।
হয়তো নগেন স্যাকরাকে দেখা গেল, একটা গামছা কোনোমতে মালকোঁচা মেরে উঠেীনের চড়চড়ে রোদে উদোম গায়ে সটান উপুড় হয়ে পড়ে আছে মাদুরের ওপর। আর তার তেল জবজবে পিঠে আচ্ছামতো মালিশ করে দিচ্ছে মাধু। হচ্ছে না কিছু হচ্ছে না, আরো চাপ দাও, আরো চাপ দাও–
আমাদের দিকে চোখ পড়ায় হয়তো মাধু বলে উঠল, ওমা দ্যাখো দ্যাখো কারা এসেছে! এসো গো খোকাদাদারা, দাঁড়িয়ে রইলে কেন, এসো–
ততক্ষণে ধড়ফড় করে উঠে বসেছে নগেন স্যাকরা। আরে, মনিবাবু যে, কি ভাগ্যি! কি ভাগ্যি! শিগগির পিঁড়ে এনে বসতে দাও মাধু, শিগগির! এ কি যে সে কথা! মনিদাদাবাবু! পোকা দাদাবাবু! অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!
আমার ছোট্ট সোনাদাদার মুখ লাল হয়ে গেছে রোদে—
এই বলে গ্লাসভরা পানি আর দুটো বাতাসা হাতে দিতো মাধু।
দু-একদিন এমন হয়েছে, মনি ভাইজান ফস করে বলে বসলো, আর নেই বাতাসা? থাকলে আরো দুটো দাও, পোকাটা একেবারে নেতিয়ে পড়েছে, কম দূরের পথ—
কাঁচুমাচু মুখে মাধু বলে, আজ তো আর নেই মনি দাদাবাবু! বেশি করে আনিয়ে রাখবো এরপর থেকে। ছোট্ট সোনাদাদাকে একদিন সন্দেশ খাওয়াব—
মা যেতে বলেছে তোমাকে আজকেই—
মনি ভাইজানের মুখে একথা শুনে নগেন স্যাকরা বলতো, আজকেই! নিজের চোখে তো দেখলে মনিবাবু, আজকে কি করে যাই! শরীরের গাঁটে গাঁটে খিল। ঝাড়ের বাঁশ, কিছুতেই আর ভাঙতে চায় না। কালই যাচ্ছি আমি, চিন্তা করতে বারণ করো মাকে–
কাল না গেলে কিন্তু ভালো হবে না–
অবশ্যই যাব, অবশ্যই যাবো! আমার নিজের গরজ আছে না? কতোদিন মাকে দেখিনি, কালই যাব।
ফেরার সময় ইচ্ছে করে একটা রূপোর আধুলি ফেলে রেখে আসে মনি ভাইজান উঠানের একপাশে। আমি দেখে ফেলায় বলে, কাউকে বলবি না, মাকেও না!
এই রকম ছিল সেসব।
একদিন দেখা গেল সত্যি সত্যিই পকেটে কোঁচা গুজে হাজির নগেন স্যাকরা। মা, মা কই— দরোজার বাইরে থেকেই চেঁচানি শুরু হয়ে যেতো তার। তারপর অনেকক্ষণ ধরে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে বাঁধাগতে সে বলতো, ছেলেকে মাপ করে দিন মা! মাপ না করলে আমি কিছুতেই মাথা তুলবো না।
যতো রকমের নষ্টামি আছে সব শিখেছ–এইভাবে শুরু হতো ঝাড়াই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মার রাগ পড়ে যেতো। বলতো, বোস, আমার জিনিস কই।
হয়ে এসেছে, এখন কেবল ছিলতে যে সময়টুকু। তা আগামী হপ্তাতেই পেয়ে যাবেন—
তোমার কথা আর ব্যাঙের মাথা!
মার যেমন কথা। দেখবেন এবারে কথার একন্নো আর নড়চড় হবে না।
একবার এলে সহজে আর উঠতে চাইতো না। বসে বসে রাজ্যির কথার ভুশুড়ি ভাঙতো সে। আঁটুলি হয়ে যেত। আমি কিন্তু চা না খেয়ে উঠব না, কতদিন মার হাতের চা খাইনি–
সে আমি জানি!
চা-মুড়ি খেতে খেতে সে বলতো, এইভাবে আপনাদের পাঁচজনের দয়ায় কোনোরকমে জীবন কাটছে মা, বড় কষ্ট!
তুমি তো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছো। হাটেবাজারে পড়ে থাক, ঘর-সংসার দ্যাখে কে, এখন আর তোমাকে বিশ্বাস করে কে কাজ দেবে–
দিব্যি করে বলছি মা ইচ্ছে করে কাউকে আমি ফাঁকি দিইনি। সময়মতো দিতে পারিনি, দু আনা সোনা এদিক-সেদিক হয়ে গেছে, এইটুকুই তো অপরাধ। তা সে আমি দিয়ে দেব। কড়ায় ক্রান্তিতে আমি সকলের সব পাওনা মিটিয়ে দেব, সব হিসেব আছে আমার কাছে, ফাঁকি দিলে সে নরকেও ঠাঁই পাবো না!