একবার এলো একটা খাড়া অন্ধ লোক। রোগা-পাতলা ছিপছিপে চেহারা। লোকটির দুটো চোখই পাথরের।
মার পরনে ছিল খুব চিকন পাড়ের সাদা শাড়ি। সে বললে, আপনার এ বিধবার বেশ কেন মা?
মা তো অবাক!
মনি ভাইজান আঙুল তুলে বললে, বলো দেখি কটা আঙুল?
লোকটি বললে, তিনটে।
এবার বলো, কি দেখছো?
লোকটি হেসে বললে, তুমি তো ভারি পাজি ছেলে হে! তুমি বক দেখাচ্ছো!
মনি ভাইজান বললে, এসব তোমার চালাকি। তুমি সব দেখতে পাও।
লোকটি বললে, দেখতে না পেলে বলছি কি করে! তবে তোমরা যেমন চোখ দিয়ে দ্যাখো, তেমন নয়!
ঠিক আছে দেখা যাবে, মনি ভাইজান বললে, আমি তোমার চোখ বেঁধে দেব, কামড়ালে কিন্তু ভালো হবে না!
গামছা দিয়ে কষে চোখ বেঁধে দেওয়ার পর মনি ভাইজান বললে, আচ্ছা এবার বলো কি দেখছো?
একটা বই, বিষাদ সিন্ধু!
এবার?
একটা ছবি, সুভাষচন্দ্র বসু!
মা বললে, তুই সর তো, আপনি কি চাল নেবেন, না পয়সা?
লোকটি বললে, ওসব নিয়ে আমি কি করবো মা? ইচ্ছে করলে আমাকে একমুঠো ভাত খাওয়াতে পারেন!
মা জিজ্ঞেস করলে, আপনি হিন্দু না মুসলমান?
সে বললে, আমি হিন্দু!
আমরা মুসলামান, আমাদের এখানে খাবেন?
মার কথার উত্তরে সে বললে, অন্নের কি কোনো জাত আছে মা?
লোকটি যখন খাচ্ছে তখন মনি ভাইজান কাছে বসে বললে, আমাকে চোখ বন্ধ করে দেখতে শেখাবেন!
কে কাকে শেখায়! শিখতে হয়।
মনি ভাইজান নাছোড়বান্দার মতো বললে, আমি আপনার পা টিপে দেব, যা বলবেন তাই করব, আপনি আমাকে শেখান।
লোকটি হেসে বললে, তোমার তো চোখ আছে বাবা, চেষ্টা করলেও তুমি পারবে না। তোমার মতো আমার চোখ নেই, তাই মন দিয়ে দেখতে হয়। মন সব পারে। ঐ যে এতো উঁচু হিমালয়, ইচ্ছে করলে এক লাফে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারে ওটাকেও।
মনি ভাইজান বললে, ঠিক আছে, আপনি না হয় আমার চোখ নষ্ট করে দিন…
লোকটি মনি ভাইজানের পিঠে একটা হাত রেখে অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো। বললে, তুমি খুব বোকা। চোখ দিয়ে যা দেখা যায়, তার সবই তো তুমি দেখতে পাচ্ছো; এর জন্যে আবার মনকে টেনে আনা কেন? চোখের চেয়ে মনের দেখার ক্ষমতা অনেক বেশি, সে অনেক দ্যাখে, অনেকদূর পর্যন্ত দ্যাখে, চোখ যা পারে না। তা তুমি যদি সেই সব দেখতে চাও, তাহলে আগে মনকে খুঁজতে হবে—
মনি ভাইজান বললে কি ভাবে—
যেমন ধরো আগে বের করতে হবে, সে আছে কোথায়। যখন বুঝবে সে ঐখানে, তখন তার কাছে যাবে বলবে আমি দেখতে চাই। সে আমাকে যা বলেছিল, তোমাকেই সেই একই কথা বলবে। বলবে, তুমি লোভী, লোভীরা কখনো দেখতে পায় না। তুমি সময় চাইবে। নিজেকে সংশোধন করে তারপর আবার তার কাছে যাবে। বলবে এখন আর আমার কোনো লোভ নেই, তুমি আমাকে যেমন ইচ্ছে বাজিয়ে দ্যাখো। সে পরীক্ষায় যদি তুমি টিকে যাও, তাহলে তখনকার তখনই তোমার মনের চোখ খুলে যাবে–
যাবার সময় চাপা গলায় লোকটি মাকে বললো, খেয়াল রাখবেন এর দিকে, বিশেষ যত্ন নেবেন। জগতে এমন কিছু মানুষ জন্মায় যারা, কেবল কষ্ট পেতেই ভালোবাসে–
কেমন যেন মনমরা হয়ে গিয়েছিল মনি ভাইজান এরপর থেকে। কারো সঙ্গেই মিশতো না। একা একা পুকুরপাড়ে বসে সবসময় পানির দিকে তাকিয়ে থাকতো। কখনো দ্যাখো পিঁপড়েদের চিনি খাওয়াচ্ছে, কখনো দ্যাখো গাছতলায় মাটির ওপর শুয়ে আছে, বলতে গেলে একেবারে অন্য রকমই হয়ে গিয়েছিল।
শেষে পড়লো জ্বরে। মাসখানেক ভুগেছিল। টাইফয়েড ধরনের একটা কিছু। সেরে যখন উঠলো, তখন আর চেনাই যায় না। দারুণ ভেঙে গিয়েছিল স্বাস্থ্য।
আবার সেই আগের মতো। ছবিদিকে দেখলেই চোখ ট্যারা করে বলে, স্টাইল! ব-র-ক-ধ-ঝ কুড় বা কুড় বা কুড় বা নিজ্জে—
ছবিদি খেপে ওঠে, ছোটলোক, গুণ্ডা।
রানিবুবুকে খোঁচা মেরে বলে, ভ্যাঁ!
রানিবুবু ছুটে যায় মার কাছে নালিশ করতে, তখন নিজে নিজেই কান ধরে ওঠ-বস করতে করতে মনি ভাইজান বলে, ঠিক আছে। ওকথা আর বলবো না, বলবো খ-চ-ট-ত-প-
পানুকে দেখতে পেয়ে বলে, বল ব্যাটা, ঝিনজার মানে কি?
পানু ভয়ে ভয়ে বলে, ঝাঁজা—
বাড়াবাড়িও ছিল। যেমন একবার:
গিনজার মানে কি?
গাঁজা–
চটে যাবার ভান করে মনি ভাইজান বললে, খোল ব্যাটা, প্যান্ট খোল। এই, কে আছিস, চাকু নিয়ে যায়, আজ ওর নুনু কাটবো, ওকে মুসলমান বানিয়ে ছাড়বো। বল আল্লাহ!
ভয়ে ভয়ে আলা না কি যেন বলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিল পানু। সে বললে, ভগবান রাগ করবে, আমি পারবো না মনিদা, আমি পারবো না–
এ নিয়ে এক বিরাট ঝক্কি বেধেছিল। কিন্তু সেকথা যাক। কেনারাম কাকা মনি ভাইজানের হয়ে একদল উত্তেজিত মানুষের সামনে জোড়হাতে ক্ষমা চেয়েছিলেন, শুধু এইটুকু মনে আছে।
একটি বুড়ো ছিটকাপড়ওয়ালা ছিল। নমাস ছমাসে সে পিঠে ছিটকাপড়ের গাঁটরি নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতো। খুব সম্ভব তার নাম ছিল জমাতালি। লোকটার সারা মুখে ছিল বসন্তের দাগ। যা সুন্দর ছিল তার হাসি! মনি ভাইজান বলতো, কোথেকে শিখেছ?
সে বলতো, শিখিনি, চাঁদনিচকের এক দোকান থেকে নগদ নসিকে দিয়ে কিনেছি।
দোকানের নাম?
হনহনে হাজরার দোকান। সবাই চেনে, জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে। কতো রকমের যে ভ্যারাইটি। আসামি, মাদ্রাজি, কাশ্মিরি, বিলিতি, সে কতো রকমের। তা তুমি তো আর আমার মতো গরিব নও, তুমি কাশিরটাই নিও, দামটা একটু চড়া, এই যা। হোক চড়া, তবে সুতো খুব খাঁটি, বুননও খুব ভালো; এমন মিহি পাকা রঙের যে, রোদ-বৃষ্টির সঙ্গে বাজি ধরলে জিতে যাবে।