টিপু ভাইজান বললে, সাপে কামড়াতে পারে–
এতো কষ্ট পেয়েছিল! ও মরুক, এতো কষ্ট চোখে দেখা যায়। এই বলে কেঁদে উঠেছিল মা।
কান্নাকাটির ধুম পড়ায় পাড়াপ্রতিবেশীদের ভিড়ে ঘর ভরে গিয়েছিল, সে এক হুলস্থুল কাণ্ড।
আব্বা অফিস থেকে ফিরে এইসব কাণ্ড-কারখানা দেখে বোকা হয়ে গিয়েছিল। ছি, ছি, লোকে বলবে কি, কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই তোমাদের, এটা একটা ব্যাপার হলো?
সেই রাতেই কেনারাম কাকা থলের ভেতর ভরে একটা নতুন বিড়াল এনে হাজির করেছিলেন। অন্যেরা থামলেও রানিবুবুকে শান্ত করা যায়নি। কতো সুন্দর ছিল কুন্তি, কতো শান্ত–
হয়তো তাই, কুন্তির মতো আর হয়নি, অমন সুন্দর আর হয় না। বিছানার ওপরের একফালি চিকচিকে রোদ সারা গায়ে পাউডারের মতো মেখে রাজরাণীর মতো বসে থাকতো কুন্তি। রানিবুবুর পড়ার সময় অঘোরে ঘুমাতো সে কে।লের ভেতর। কখনো মোটা দেখে একটা খাতা বেছে নিয়ে বসতো, তার ওপর বসে বসে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো সে মুখের দিকে।
কেনারাম কাকার দেয়া বিড়ালের নাম দেয়া হয়েছিল টোটা। টোটা ছিল ভীষণ বেয়াড়া। প্রায়ই সে পালিয়ে যেতো। তখন বাড়ি বাড়ি খোঁজা হতো। কতোবার যে ধরে আনতে হয়েছে তাকে। কারো কাছে বড় একটা ঘেষতো না সে, কেমন যেন একা একা স্বভাবের। আমাদের কাউকেই তার মনে ধরেনি। অবিশ্বাসের চোখে সে কটমট করে তাকিয়ে থাকতো। পাঁচিলের ওপরে শুয়ে শুয়ে কাটাতো সারাদিন। খিদে পেলে তবে ঘরে ঢুকতো, তারপর মিউমিউ করে ডাকতো, এমন ছিল তার জিদ।
একবার একটা শালিকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। সে ছিল খোঁড়া,, যেভাবেই হোক একটা ঠ্যাং তার ভেঙে গিয়েছিল। বাগানে গেলে আমাকে দেখলেই সে উড়ে আসতো, তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে কাছে এসে কা কা চেঁচানি জুড়ে দিত। ধরে ধরে ফড়িং খাওয়াতাম ওকে। মনি ভাইজান একদিন বললে, শালিকটা কে জানিস?
আমি বললাম, কে?
আমাদের এক বোন। তুই দেখিসনি। তোর জন্মের ঠিক আগেই ও মরে যায়। ওর নাম ছিল তুলি–
ও তো পাখি!
মনি ভাইজান বললে, মরে পাখি হয়ে গেছে। আমরা তো ভাই, তাই আমাদের মায়া কাটাতে পারে না।
সব শুনে হাহাকার করে উঠেছিল বুকের ভেতর। তুলির কথা মনে পড়লে মাকেও দেখছি বসে বসে কাঁদতে।।
তারপর থেকে আমার একটাই কাজ, মাটির খুরিতে ভাত আর মাছ নিয়ে ফলশা গাছের পাশে সারা দুপুর বসে থাকা। বসে বসে কাঁটা বেছে মাছ-ভাত খাওয়াতাম। শুধু ভয় হতো, এই বুঝি কাঁটা বিধল গলায়। জিগ্যেস করতাম, তোমার কষ্ট হয়?
শীত লাগে না?
লেপের ভেতর শুতে চাও?
মা তোমার জন্যে এখনো কাঁদে—
সব কথার একটাই জবাব ছিল তার, ক্যাঁ, ক্যাঁ। রাগ হতো। নিজের ওপর। ও-তো সব বলে, ওর সব কথা; সব দুঃখ, সব কষ্ট সবকিছুর কথা। কেবল আমি এমন গাধা যে, তার এক বর্ণও বুঝি না।
পুঁটিকে জিজ্ঞেস করলাম একবার, পুঁটি তুমি পাখির কথা বোঝ?
পুঁটি বললে, ওমা, ওটা আবার একটা কাজ, ও তো খুব সহজ।
শালিকের কথা বোঝ?
বুঝবো না কেন! তবে শালিকদের ভাষা হলো তোর গিয়ে ওই উড়েদের মতো; তংকা বংকা হইছন্তি খাইছন্তি এই ধরনের, আমাদের নটবরের কথা শুনিসনি! তা যাই বল, বেশ কঠিন!
সব শুনে পুঁটি বললে, আমার সময় কখন যে, এতোসব শেখাবো তোকে? আমাদের বাবুদের বাড়ির দেমাকী বৌ মাগীর চোপা তো আর শুনিসনি! মাগীর দাতে আমি দড়ি হয়ে গেলাম, মলেও বাঁচি। উঠতে-বসতে শুধু কাজ আর কাজ। একটা হয়, ও যা বলে, আমি তা তোকে বুঝিয়ে দিতে পারি। কিন্তু কি দিবি আমাকে?
একটা ডবল পয়সা হাতে ভরে আমার সঙ্গে বাগানে গিয়েছিল পুঁটি। মাটির খুরি উল্টে শালিকটা যখন ভাতের ডেলা খাচ্ছে আর কা কা করছে, তখন পুঁটি বললে, ওমা, কি পাকা মেয়েরে বাবা, কি বলছে জানিস, বলছে, ও পাকা, পোকা, তোর খুব সুন্দর বউ হবে! ও পোকা, পোকা, তোমার বউ ঠিক পুঁটির মতো সুন্দর হবে। দেখেছ, কি চালাক! ওমা, পেটে পেটে কি বুদ্ধি!
বললাম, জিজ্ঞেস কর না, পা ভাঙলে কি করে?
পুঁটি বললে, ও তুলি, কি হয়েছিল তোমার পায়ে?
ক্যাঁ ক্যাঁ করে শালিকটা ডাকার পর পুঁটি বললে, দেখেছ দেখেছ, কি বজ্জাত! আমাকে নচ্ছার বলে গাল দিল। পাকিস্তান চায় বলে হিন্দু পাখিরা নাকি ওর ঠ্যাং ভেঙে দিয়েছে, শোন কথা! তা আমার কি দোষ বলো? ঐ শোন আবার কি বললে! বলছে, তোমার জাতভেয়েরা তো করেছে—
তুলিপাখি যে অমন গাল দিতে পারে, আমার তা বিশ্বাস হতো না। কতো দুপুর গাছতলায় বসে বসে কেটেছে। হা-পিত্যেশ করে বসে আছি, খুরিতে ভাত নিয়ে, আসে না, আসে না, কিছুতেই আর আসে না। শেষে হয়তো এলো।
যেদিন তুলি আসতো না, সবকিছু ফাঁকা হয়ে যেতো। সে যে কি কষ্ট! বুকের ভেতর গুমরে উঠতো কান্না। তখন সব পাখিদের দেখে আমার কান্না আসতো। কতো লোকের কতো ভাইবোন মরে গিয়ে এইভাবে পাখি হয়ে আছে, কেউ ওদের দ্যাখে না। কতো দুঃখ ওদের! রোদ-বৃষ্টি-শীতে কতো কষ্টই না ওদের হয়! না আছে ঘর, না লেপ-তোষক-কথা; গাছের ডালে ডালে কতো অনাদরে, কতো অবহেলায় ওদের দিন কাটে!
সেই তুলি, সেই তুলিপাখি, আমাদের সেই ছোট্ট বোন, একদিন কোথায় যে উড়ে গেল, আর সে ফেরেনি। মধুগুলগুলি আর সিঁদুর কৌটো আমগাছের ডালে শেষবারের মতো তাকে দেখা গেল; কোনো কথা বললে না সে। কি জানি, কেনু তার এমন অভিমান হলো।
এক একদিন এক একটা অদ্ভুত মানুষ এসে হাজির হতো। অবিকল গরুর মতো হাম্বা শব্দ করে দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের পয়সা বাজাতে লাগলো। একদিন একটা যমদূতের মতো লোক, তার গলায় জড়ানো মোটা দড়ি। ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়েছিলাম, মনে আছে। চাল আর একটা আনি নিয়ে তবে সে নড়েছিল। মার মুখে শুনেছিলাম, লোকটার নাকি গরু মরেছে। মরার সময় গরুর গলায় দড়ি থাকলে তার মালিককে নাকি এইভাবেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। গলায় দড়ি পেঁচিয়ে ঝাড়া এক মাস বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাকে ভিক্ষে করতে হবে। কথা বলা বারণ।।