এইসব মন খারাপ করা কথা কেন তোলো রেখা?
মন খারাপ হয় কেন, নিজের গাঁটের ওজন বুঝবে না! ছেলে বলতে একটা, তা-ও কিভাবে মানুষ হচ্ছে। মানুষ হবে না ছাই। শহরে থাকলে একটা ভালো ইস্কুলে যেতো, সবকিছু শিখতো। এখানো ধুলোকাদা মাখছে, সারাদিন ইচ্ছেমতো গড়াগড়ি খাচ্ছে, চাষাভুষাদের ছেলেমেয়েদের কাছে শিখবেটা কি!
আবদুল খালেক বললে, এইতালো, কাদামাটি চিনুক, ধুলোবালি চিনুক।।
হ্যাঁ, তাতে তোমার মুখ উজ্বল হবে—
হঠাৎ কি মনে করে আবদুল খালেক বললে, রানিবুবুর চিঠির উত্তর দিয়েছিলে?
না!
সে কি কথা, তুমি না বললে তুমি জবাব দেবে।
তুমিও তো পারতে।
আমি পারলে আর তোমাকে বলতাম না, কখনো চিঠির উত্তর আমি দিতে পেরেছি? হচ্ছে—হবে, দিচ্ছি-দেববা করে শেষ পর্যন্ত কোনোদিন আমার উত্তর লেখা হয়ে ওঠে না। তোমার কিন্তু উচিত ছিল। রানিবুবুর অমন জ্বলজ্যান্ত ছেলেটা মারা গেল, যাওয়া তো হলোই না, এমনকি চিঠির উত্তরও না, খুব খারাপ হলো ব্যাপারটা।
রেখা বললে, তুমি তো দেখছি সবই বোঝ, উচিত-অনুচিত জ্ঞান তোমার টনটনে, লেখ না কেন, ধরে রেখেছে কেউ তোমাকে?
আবদুল খালেক বললে, জীবন কি রকম বদলে যায়, কি আশ্চর্য দ্যাখো। রেখা কিভাবে সবকিছু বদলে যায়।
একসময় এক বিছানায় গলা জড়াজড়ি করে শুয়েছি, এক পাতে খেয়েছি, চোখের আড়াল হইনি কেউ কারো, অথচ আজ রূপকথা, আদ্যিকালের গপ্পো। টিপু ভাইজানকেও কতোদিন দেখিনি, পাঁচ বছর হলো। এখন আর মনেই পড়ে না।
তোমার পেয়ারের ভাবী তো খবর নিতে পারে, তিনি না হয় ব্যস্ত মানুষ, ডাক্তারিতে ডুবে থাকেন। একসময় তো খুব মাখামাখি ছিল তোমার সঙ্গে।
কেন যে তুমি ওভাবে কথা বলো— আবদুল খালেক দুঃখিত হয়ে বললে, গুরুজনদের ব্যাপারে অশ্রদ্ধা, থাকতে নেই, এতে নিজের ওজনই হাল্কা হয়। এরাই বোধহয় সবচেয়ে দুঃখী–
রেখা আর কোনো কথা না বলায় অস্বস্তি বোধ করে আবদুল খালেক। সে বললে, আগে তো লিখতোই। কটা উত্তর আমরা লিখেছি। আরবের মতো একটা রুভূমিতে পড়ে আছে, ওদেরও তো কতো সমস্যা থাকতে পারে, কতোটুকুই বা আমরা জানি, কিই-বা আমরা জানি—
রেখা বললে, প্রথম প্রথম তো খুব বড়মানুষি দেখাতে পেরেছিল। কেউ এলেই এটা সেটা পাঠাতে, এখন চিঠি লিখেও পোছে না।
এক এক সময় এইরকম থাকে। মনে হয় কাউকে ছাড়া কারো চলবে না, সব সম্পর্কই দামী, সবকিছু রক্ষে করে চলতে হবে। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে যার সংসারের ভেতর নাকঅব্দি ডুবে গেছে, চোখ ফিরিয়ে তাকাবার উপায়ও তার নেই। এই নিজেদের দিকেই দ্যাখো না, ইচ্ছে থাকলেও কোন্ কাজটা আমরা করতে পারছি
রেখা বললে, বড়দের একটা আলাদা কর্তব্য থাকে। টিপু ভাইজানের কি উচিত ছিল না আমাদের খোঁজখবর রাখার? তোমাদের প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের ছোট ছেলে তো সৌদি আরবে গেল সেদিন, মাত্র বছরখানেক। কি না পাঠিয়েছে এর মধ্যে। টিভি থেকে শুরু করে থ্রি-ইন-ওয়ান, ঘড়ি কি না। ওনার তো আর কোনো অভাব ছিল না, তবুও তো পাঠিয়েছে। আসলে মন থাকা দরকার। তুমি কি মনে কর তোমাকে কেউ খুব গ্রাহ্যের মধ্যে একটা আনে?
আবদুল খালেক হেসে বললে, তোমার ইস্কুল আলাদা, এই আর কি?
রেখা বললে, তা গিরিবালা মাগীটা কে শুনি, হঠাৎ তার কথা মনে পড়লো কেন?
আবদুল খালেক বাইরের দিকে হাত বাড়ালো। বললে, বাইরে আকাশ বলে একটা কিছু আছে, তা জান তো! সেখানে একটা চাঁদ আছে, গোল চাঁদ। ঐ চাঁদের ভেতর হাঁটুমুড়ে কতোকাল ধরে বসে আছে। চরকায় সুতো কাটছে বসে বসে।
০৫. কাগজের নৌকো
বৃষ্টি এলেই কাগজের নৌকো বানানোর ধুম শুরু হতো, আর কেউ বড়ি দিলেই বৃষ্টি আসতো।
মনি ভাইজান তৈরি করতো তিনপালের জাহাজ। এক একটা জাহাজের এক একটা নাম থাকতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ। প্রিন্স অব ওয়েলস। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে থাকতো চালভাজা, প্রিন্স অব ওয়েলস-এ কালো পিঁপড়ে, সুড়সুড়ি পিঁপড়ে। কিছুদূর গিয়েই বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় চাবচুব হয়ে জাহাজগুলো ডুবে যেত। মনি ভাইজান বলতো, ইংরেজদের দিন শেষ হয়ে আসছে–
তারপর ভাসমান পিপড়েগুলোর পাশে শুকনো পাতা ছেড়ে দিত মনি ভাইজান। বলতে লাইফবোট, অন্তত চেষ্টা করা যাক, যাতে ওরা প্রাণে বাঁচে—
তোজো আজ খুশির চোটে আস্ত একখানা ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাবে, বুঝলি পোকা!
তুমুল বৃষ্টির পর কেঁচো বেরুতো। রানিবুবুর বিড়াল কুন্তির খুব অপছন্দের ছিল এই কেঁচো। কেঁচো দেখলেই সে ফ্ল্যাশ ফাশ জুড়ে দিয়ে লাফালাফি করতো।
কুন্তি মনি ভাইজানের ধারেকাছে বড় একটা ঘেঁষতে চাইতো না, কি জানি, ভয় পেত বোধহয়। হয় একটা কাগজের ঠোঙার ভেতরে কুন্তির মাথা পুরে দিল, কুন্তি পিছনে হটা শুরু করলো, না হয় একটা ফিতে বেঁধে দিল কষে তার লেজে, মনি ভাইজান কুন্তিকে এইভাবে শাস্তি দিত। রানিবুবুকে কাঁদানোর সবচেয়ে সহজ রাস্তা ছিল এটাই।
রানিবুবুকে ভ্যা বললেই ক্ষেপে যেতো। মনি ভাইজান কতো কিছু যে বের করতো মাথা থেকে।
কুন্তির মারা যাওয়াটা বিরাট ঘটনা। আমরা বাড়িসুদ্ধ সবাই কেঁদেছিলাম। মুখে রক্ত তুলে আছড়ে-পিছড়ৈ মরেছিল কুন্তি, কে জানে কি হয়েছিল। এক সন্ধ্যায় হঠাৎ বাগান থেকে ঘরে ঢুকলো সে, ঢুকে রানিবুবুর পায়ে গা ঘসে ম্যাও ম্যাও জুড়ে দিল, তারপরই শুরু হলো তার ছটফটানি। সে কি কষ্ট! দেখা যায় না। মা বললে, ওকে কেউ কিছু খাইয়ে দিয়েছে—