- বইয়ের নামঃ কালো বরফ
- লেখকের নামঃ মাহমুদুল হক
- প্রকাশনাঃ সাহিত্য প্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বুড়ো আঙুল চোষা
তখন আমার অভ্যেস ছিল বুড়ো আঙুল চোষার। কখনো পুকুরঘাটে, কখনো বারান্দার সিঁড়িতে, কখনো-বা জানালায় একা একা বসে কেবল আঙুল চুষতাম। আঙুলের নোনতা স্বাদ যে খুব ভালো লাগতো, ঠিক সে রকম কোনো ব্যাপার নয়। তখন ভালোলাগা বা মন্দলাগা এসবের কোনো ঝক্কি ছিল না, যতোটুকু মনে পড়ে; পৃথিবী যে গোল, একথা শুনে কানমাথা রীতিমতো ঝাঁ ঝাঁ করতো। সে একটা গোলমেলে বিষম ব্যাপার। ভাবতা আমরা তাহলে কোথায় আছি, কমলালেবুর তলার দিকে না ওপরের দিকে; তলার দিকের মানুষজনের তো টুপটাপ ঝরে পড়ার কথা।
একবার সাধুখাঁদের ছেলে পাঁচু কাচের চুড়ির একটা শেকল আমাকে উপহার দেয়, শেকলটি তার বোন ঝুমির। ঝুমির পুতুলের বাক্স থেকে সে ঐ জিনিসটি হাতিয়েছিল। শেকলটি আমি লুকিয়ে রাখতাম। আমার ধারণা ছিল অমন সুন্দর জিনিস খুব বেশি একটা নেই কারো কাছে।
ঝুমি প্রায়ই আমাদের বাগানে ঘোরাফেরা করতো। সামনাসামনি পড়ে গেলে মুখ নিচু করে পালাতে চাইতাম, চোখ তুলে কথা বলতে পারতাম না, ভয়ে বুকের ভেতর গুবগুব করতো। ঝুমি যেদিন জিগ্যেস করলে এ্যাই, পাঁচু তোকে কিছু দিয়েছে–সেদিন ভয়ে আমি কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম। পরে বুঝেছিলাম ওটা ছিল নিছক কথার কথা, ঝুমি আমার কথা জানতো না।
সে যাক, রঙিন ভাঙা চুড়ির শেকল যে খুব সস্তাদরের, একথা আমি জেনেছিলাম আরো অনেক পরে।
এই ধরনের একটা বয়েস।
এটা ঠিক যে, আমার এই আঙুল চোষার ব্যাপারটা বাড়ির কারোই তেমন পছন্দের ছিল না, মার কাছে তো নয়ই। অনেক খোঁচা খেয়েছি এর জন্য। এই হাবলুটাকে নিয়ে হয়েছে আমার যতো ঝক্কি এই বলে আমার গাল থেকে আঙুল বের করে দিত মা। আমি তো জানিই, নচ্ছরটা আমাকে জ্বালাবে— রেগে গেলে মা বলতো, পেটে থাকতেও দিনরাত হেঁড়েমাথাটা কি কম জ্বালান জ্বালিয়েছে আমাকে।
দুটোর কোনোটাই বোধহয় মিথ্যে নয়। খুব সম্ভব আমি কমবেশি হাবাগোছেরই ছিলাম। ঠোঙার একটা নকুলদানা পড়ে গেলেও ধুলেমাটি থেকে তা কুড়িয়ে গালে পুরতাম। পুঁটি নামের যে আলতাপায়ে মেয়েটি রোজ আমাদের পুকুরঘাটে গুচ্ছের পেতল কাঁসার থালাবাসন নিয়ে বসতো, সেও আমার কাছে ছিল এক বিস্ময়ের বস্তু।
অনেকক্ষণ ধরে বসে সে পিতলের থালা বাসনে নুড়ো ডলতো আর পিনপি করে গান গাইতো, পকেটে চেন ঝুলিয়ে চোদ্দসিকের বাবুয়ানা–তার সে মাজাঘসা আর শেষই হয় । এর মধ্যে দুচারবার ডাক তো আসবেই, পুঁটি, অপুঁটি মরলো নাকি ছুঁড়ি!
যতোবারই ডাক আসবে তার সেই একই জবাব, যাইমা–
ধেড়ে মাছ ছিল একটা পুকুরে, রুই কি কাতলা, বয়েসের কোনো গাছপাথর ছিল না মাছটার; কি করে যেন সে ঠিকই টের পেত পুঁটি ঘাটে এসেছে। পুকুরের ঠিক মাঝখানে দুচারটে ঘাই মেরে, তারপর একডুবে সে সরাসরি ঘাটের কাছে হুপুস করে ভেসে উঠতো। পুঁটি হয়তো তখন ঝিনুক দিয়ে চেঁচে চেঁচে দুধের হাঁড়ির পোড়া সর খাচ্ছে। রাখ, তোর হ্যাংলামি আমি একদিন বার করবো, কি ছোঁচারে বাবা–মাছের সঙ্গে এইভাবে কথা শুরু করে দিত পুঁটি, এতো নোলা কেন? রোজ জ্বালাতন! রোজ জ্বালাতন!
বলতাম, তোমার কথা বোঝে?
ওমা, বুঝবে না কেন। পুঁটি পড়তো আকাশ থেকে। বলতো, আমিও তো ওর কথা বুঝি। ঐ যে বুড়বুড়ি তোলে, ঐসবই তো ওর কথা। কি বলে জানিস? বলে, ও পুঁটি, তুমি কি ভালো মেয়ে, তোমার মুটুকপরা রাজপুতুরের মতো টুকটুকে বর হবে, তুমি সোনার পালঙ্কে শুয়ে ঘুমুবে, হাজারগও দাসী-বাঁদী তোমার পা টিপবে, এখন তুমি আমাকে একটু সরের চাছি খেতে দাও
সত্যি তুমি সব কথা বোঝ?
সত্যি না তো কি মিথ্যে! রোজ রোজ কতো আশীৰ্বাদ করে আমাকে! আর করবে নাই বা কেন, সর খেতে কার না ভালো লাগে!
পুঁটির যে গাছ-গাছড়ার সঙ্গে কথা হয়, এও আমার নিজ চোখে দেখা। আকন্দগাছের গোড়ায় ঘটি উপুড় করে দিয়ে সে বলতো গাছভাই গাছভাই, এই দ্যাখো আমি তোমার গোড়ায় একঘটি জল দিলাম, আমার যেন খুব ভালো বর হয়, নইলে কিন্তু খুব খারাপ হবে, একটা ডালপালাও তোমার আস্ত থাকবে না–
শিমুলগাছ ছিল একটা, চুপি চুপি তার গোড়াতেও ঘটি উপুড় করা বাঁধাধরা কাজ ছিল। বলবে, কি থেকে কি আসে কি থেকে কি হয় তুই তার কি জানিস! সেই যে কাঁঠালে না দেগঙ্গায় শিমুল গাছের গোড়ায় একঘড়া সোনার মোহর পেয়েছিল এক মুচি, সে-কি আর এমনি এমনিই, গাছটাকে ভক্তি করতো বলেই তো পেয়েছিল। কম গয়নাগাটি লাগবে বিয়েতে। মাঝে মাঝে তো স্বপ্ন দেখিই, গাছটার গোড়ায় মাটির নিচে এই ইয়া বড় একটা লোহার সিন্দুক, একটা আলসে ময়াল সেটার ভেতরে শুয়ে শুয়ে পাহারা দিচ্ছে—
একদিন বললাম, পুঁটি সর খাওয়াবে—
পুঁটি মুখ কালো করে বললে, বলিহারি নোলা বাপু! খুব করে নজর দিস বুঝি রোজ। নোলাটাকে একটু কষতে পারিস না, কি হাঘরে! তাই তো ভাবি রোজ রোজ শুধু শুধু এমন পেট ব্যথা করে কেন!
পরে অবশ্য একটু নরোম হয়েছিল পুঁটি।
ঠিক আছে, তোকে একদিন পোড়া সর খাওয়াব, কিন্তু তার বদলে কি দিবি আমাকে?
কি আর দেবো, তুমি-ই বলো—
তোদের না, একটা পেতলের পটলচেরা কাজললতা আছে, দিতে পারবি আমাকে?
পারবো–
কাউকে বলতে পারবি না কিন্তু, আমার ছেলে হলে ধ্যাবড়া করে কপালে টিপ দিয়ে দিতে হবে না কাজলের, নৈলেপরে নজর লাগবে। কি আর এমন দাম ওটার! যদি পারিস, মাছের সঙ্গেও তোর বন্ধুত্ব পাতিয়ে দেবো।