সত্য-মিথ্যা জানে না, মোটকথা এইসব সূত্রেই লামাদের বাগানের বদলে তাদের সকলকে অন্যত্র স্থান বেছে নিতে হয়েছে।
বেশকিছুটা দূর হয়ে যায়। তবু সে খুশি। সবসময় নিজেদের বাড়িটা চোখের সম্মুখে পাহারাদারের মতো খাড়া দাঁড়িয়ে থাকলে অনায়াস হওয়া যায় না, অহেতুক ভয় ভেতরে ভেতরে কেবলই দুরু দুরু করতে থাকে।
হাম্মাদের নড়বড়ে দোকানের পেছনে খুব নিরাপদ স্থান বেছে নিয়েছে ফকিরারা। ছিপ হুইল বড়শি পিঁপড়ের ডিম আর রকমারি মাছের চার এইসব সাজিয়ে বুড়ো হাম্মাদ হাতের তালুর ওপর কাত হয়ে শুয়ে থাকে, মেথির গন্ধে বুদ হয়ে সারাদিন অকাতরে ঘুমায়।
অনুর মনে হয় পিঁপড়ে কিংবা তাদের বিভিন্ন গোত্র জীবনযাপন সবকিছু একেবারে শেষ পর্যন্ত হাম্মাদের (আহম্মদ?) জানা হয়ে গিয়েছে, আর সেই জন্যই তার আর কিছু করণীয় নেই, ভাবনার নেই, শুধু এই একটা কারণেই সে নির্বিবাদে ঘুমায়।
হাম্মাদের দোকান থেকে খানিকটা দূরে একটা নুয়ে পড় আখড়া আছে। দোকানের পেছনে দাঁড়ালে আখড়ার মটকার ত্রিশূল দেখা যায়। কয়েকদিন থেকেই জয়ঢাকের গায়ে চ্যাটাং চ্যাটাং শব্দে কাঠির ঘা পড়ছে। চড়কপুজোর প্রস্তুতি। শিবের গাজনের সময় এসে গিয়েছে, দুএকদিনের মধ্যেই গাজনের সং বের হবে, পুরোদমে তারই মহড়া চলছে আখড়ায়।
গেনদু অনুকে সাধলো, চলনাবে, গিয়া একনজর দেইখা আহি! মিয়াচাঁন গেনদু আর সে, তিনজনে মিলে গাজনের সং দেখতে চললো আখড়ায়। চলতে চলতে মিয়াচাঁন হু হু করে গান জুড়লো। গেনদু ভেংচি কেটে বললো, চিল্লায়া গানাবে চান-কপাইলা, সবতে মিলা হুনুম। বিয়া হয়া গেলে সোয়ামীর লগে তো চইলাই যাবি!
অনু অবাক হয়ে গেনদুর মুখের দিকে তাকাতেই গেনদু বললে, বুঝচি, বুঝবার পারচ নাই। মিয়াচানের চারা তো সোন্দর আর হেয় গায়ও মিড়া, ঘাটুদলের মাইনসে বিয়া কর্যা লয়া যাইবার চায়। বুঝচস কিছু? অর বাপে রাজি অইতাছে না। এতোড়ি মাল ছারবার পারলেই অরে দিয়া দিবো হাত দিয়ে পরিমাণটা দেখালো সে, যাইকগা! গানা বে!
মিয়াচাঁন চিকন গলায় গান জুড়লো;
নাহে নোলক কানে ঝুমকা
মাইয়া একখান বডে
নদর গদর চলে মাইয়া
ফুশুর-ফাশুর রডে
গেনদু বাধা দিয়ে বললে, আব্বাসউদ্দিনের গীত গা না বে, রেকটের গীত ছাড়া অনু হালায় বুঝবার পারবো না। এই হালারে লয়া মুসিবত বাইধাই রইছে।
একটু ভেবে নিয়ে মিয়াচাঁন গাইতে শুরু করলো :
সগাঁর বেড়ায় টাডি টাডি
লালশাড়ি পিনদিয়া
তোলা আছে ঢাকাই শাড়ি
কাঁয় যাইবেক পিনদিয়া
ওকি খশস্যোর কি মশস্যোর করিয়া–
এইভাবে গানে সুর তুলে চালালাৎ-কি-চালালাৎ আর ক্যাররোৎ-কি ক্যাররোৎ করতে করতে মিয়াচাঁন গেনদুর হাত ধরে আখড়ার চৌহদ্দিতে পৌঁছুলো।
ঘেসোভঁড়ি জটাধারী শিব ঘেমে চাবচুব হয়ে চৌকিতে বসে বসে হাতপাখার বাতাস খাচ্ছিলো। আর একটা নড়বড়ে টেবিলের ওপর পা ঝুলিয়ে কাত হয়ে ফুক ফুক করে সিগারেটে ঘনঘন টান মারছিলো দশমহাবিদ্যার এক অর্থাৎ কালী, হাতে টিনের লাল জিভ।
কিছু একটা বলতে হয় কতকটা সেই জন্যই সম্ভবত অনু বললে, এখন আর নাচবে না মনে হচ্ছে।
কতো আর নাচবো, হালারা অহনে রেস্ট লইতাছে।
টেবিলের ওপর বসা কালী পা দোলানি বন্ধ করে হাতের পোড়া সিগারেটের টুকরো গেনদুর গায়ের দিকে ছুঁড়ে বেঁকিয়ে উঠলো, বেজাইতা পোলাপান আয়া জুটচে সব, আব্বে নাটকির জানারা ভাগলি?
গেনদু অনুর হাত ধরে বললে, চলবে! হলািগো ডট অইচে। এলায় ফয়-ফকিরনী ভারাইটা কালীর খেতায় আগুন!
হাম্মাদের দোকানের পেছনে টোকানি আর ফকিররা যথারীতি ব্রিং খেলায় মশগুল হয়ে আছে। গেনদু সেদিকে না গিয়ে অন্য পথে পা বাড়ালো।
অনু বললে, ওদিকে যাবে না?
গেনদু মুখ কালো করে বললে, টোকানি আমার গনজি ফাইরা ফালাইচে, জোর কইরা তিনগা পাই কাইরা লইচে, ও হালার লগে আর দোস্তি না, হালায় চোর-চোট্টা। আমাগ পোলাপান পায়া বহুৎ বাহাদুরি দেহায়। কাউলকাই তো অর বাপে কল্লায় মাটামের বারি দিয়া অক্করে খুন
বাইর কর্যা দিছিলো!
বটোকানির বাবা ছুতোরের কাজ করে। খুবই গরিব ওরা, কিন্তু টোকা নিকে দেখলে কখনোই তা মনে হয় না, মনে হয় কতো সুখী, দুনিয়ায় ওর কোনো সমস্যাই নেই, কোনো কাজ নেই, কোনো দুর্ভাবনা নেই, এপাড়া ওপাড়ায় বিভোর হয়ে ব্রিং খেলছে তো খেলছেই।
সুখী মনে হয় গেনদুকেও। তার বাবা গাড়োয়ান। ওরা প্রায়ই দুবেলা পেটপুরে খেতে পায় না। পিটুনি খেতে খেতে গেনদু শুকনো উঁটার মতো। হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার শরীরের পাচনবাড়ির অসংখ্য গভীর কালো বিষণ্ণ দাগের মতো দুঃখের অন্য কোনো করুণ চিহ্ন গেনদুর চেহারায় ছিটেফোঁটাও নেই। সেও সময় অসময়ে ব্রিং খেলায় মশগুল হয়ে থাকে। কাচের মার্বেল ফুরিয়ে গেলে কাইবিচি দিয়ে খেলে। কাইবিচি না থাকলে মাটির বাটুল।
চারপেয়ে ফ্রেমে আটকানো লোহার দাঁতাল চাকায় অসময়ের শীর্ণ আখ মাড়াই হচ্ছিলো মসজিদের মুখে, গেনদু অনুর হাত চেপে ধরে অনুনয় করে বললে, খিলাইবা নিহি বন্দু?
সে সহজেই রাজি হয়।
তিনজনে তিন গ্লাস সবুজ রস পান করলো বারো আনায়। মনে হলো তার পেট কেমন যেন ঢকঢক করছে, জিভে জড়িয়ে আছে লোহার গন্ধ।
অনু মুখ সিটকে বললে, ইশ! কী কসটে গন্ধ!
গেনদু ক্ষেপে গিয়ে বললে, তরা এসবতের কি জানস? লর গন্দে শরীল মোডা অইবো, কেঁচকি মাইরা টোকানিরে কাইত কইরা ফ্যালান যাইবো, বুঝচস? তুই হালায় অক্করে বোদাই।