পরদিন দুপুরে ঠিক আগের মতোই কি করবে ভেবে পেলো না অনু। গনগনে রৌদ্রে খড়খড়ির রঙ জানালার শার্সি সব চড়চড় করে পুড়ছে। নিষিদ্ধ ছাদ রৌদ্রের তাপে লোহার মতো লাল হয়ে আছে।
নতুন করে আবার ছিন্নমস্তার মন্দির বইটা নিয়ে বসলো। ভালো লাগলো না। বাসি। খুব আশ্চর্য হয়ে গেল, কিভাবে যে বইটা এতো ভালো। লেগেছিলো আগে?
বই বন্ধ রেখে মেঝের ফরাশে শুয়ে পড়লো। ভাবলো কী-ইবা এমন হবে, মা তো আর ইংরেজিচর্চা ছেড়ে দেখতে আসছে না।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলো।
স্বপ্ন দেখলো মাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তাকে নিয়ে স্যার সন্ধানে বেরুলেন।
এক সময় বাড়ির পেছনে সাগদায় মার মৃতদেহ দেখা গেল; এয়ারগান দিয়ে বহুদিন আগে সে যেসব চড়ুই পাখি মেরেছিলো তার পাশে মৃতদেহটা মুখ থুবড়ে পড়ে, নিসাড়।
মানুষ মরে যায়, কিন্তু মা কি মরে, সে ভাবতে চেষ্টা করে। সম্পূর্ণ লোপ পায় তার বোধশক্তি; ভেতরের যাবতীয় কষ্ট ছুঁই ছুঁই করেও পরক্ষণেই আবার পালিয়ে যায়, কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে।
হঠাৎ ছাদের ওপর থেকে তাতানো লোহার মতো লাল পা নিয়ে নীলচক্ষু আব্বা ত্রুর উল্লাসে লাফিয়ে পড়লেন, হারেরেরেরেরেরেরে—তাঁর হাতে ইয়া এক শাবল!
প্রচণ্ড জোরে অমানুষিক হুঙ্কার ছেড়ে তিনি অনুর মাথায় শাবল বসিয়ে দিলেন। সে চিৎকার করে উঠলো–
যখন ঘুম ভাঙলো, দেখলো রক্তাক্ত ফরাশে তার মৃতদেহ পড়ে আছে। সেখানে অন্য কেউ নেই।
০৩.
পরদিন দুপুরেও অনু অনেকক্ষণ ছটফট করতে করতে এক সময় আগের দিনের মতোই আবার ফরাশে ঘুমিয়ে পড়লো। স্বপ্ন দেখলো লামাদের বাগানে আমগাছের মগডালে পা ঝুলিয়ে বসে লালপেড়ে শাড়ি পরা মা। গলার ওপর থেকে কেটে বাদ দেওয়া, সেখানে একটা কাস্তে।
সে দাঁড়িয়েছিলো গাছের ঠিক নিচে। ওপর থেকে মা তার গায়ে থুথু করে থুতু দিলো। দাউদাউ করে শরীরে আগুন ধরে গেল। আমগাছের ডালে কাকের ছানাগুলো পিউ পিউ করছে।
দমকা হাওয়া। হৈহল্লা হৈহল্লা হৈহল্লা।–
০৪.
অনু আর ঘুমোবে না সাব্যস্ত করেছে। জানালায় এসে দাঁড়ালো আজ। জানালার মতো পুড়তে চায়।
লামাদের বাগানে দস্যু ছেলেরা বেদম হল্লা জুড়েছে, হাউজদ্যাট হাউজদ্যাট! লামার মামা দোনলা বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যা করেছেন, তাঁর লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কবরস্থানে। ছোট্ট একটা শোক মিছিল। এখনো এক মাসও হয় নি পুকুরে ডুবে মরেছে লামা।
অনুর কানে বাজতে থাকে হাউজদ্যাট হাউজদ্যাট।
০৫.
আজ দুপুরে ঠিক একই সময়ে অনু আবার সেই জানালায়। দস্যু ছেলেরা ব্রিং খেলছে। লামাদের বাগানে প্রজাপতির ঝাঁক নেমেছে, প্রজাপতি প্রজাপতি প্রজাপতি—পাখিদের সে কি উল্লাস!
০৬.
কোনো একদিন ঝনঝনে থালার মতো দুপুরে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে একটা পাখি দারুণ চিৎকার করে উঠলো; কানে বাজলো, এসো অনু–-এসো!
০৭.
পরদিন অনু দুপুরের উদ্দেশে নিজেকে অবাক করে নিরুদ্দেশ হলো।
০৮. দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে
দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে প্রায়ই যাদের ব্রিং খেলতে দেখা যেত সেইসব ধূসর আবছা ছেলেদের সকলের নামই এখন জানা হয়ে গিয়েছে। কারো নাম ফকিরা কারো নাম টোকানি,—গেনদু লাটু ফালানি, মিয়াচাঁন আরো অনেকে।
অনুকেও তারা চিনেছে।
একদিন পকেট বোঝাই করে মার্বেল নিয়ে এলো, খেলা শিখলো। কিন্তু ফকিরা বা ফালানিদের মতো তুখোড় ওস্তাদ খেলুড়ে সে নয়, আগলিতে মারতে গিয়ে পিরিতে লাগিয়ে কিংবা পিছলির বদলে আগলিতে লাগিয়ে তার সব ব্রিং অতি অল্পক্ষণের মধ্যে সহজেই নিঃশেষিত হয়ে গেল। বেশকিছু পয়সাও গেল তার। জিত্তির মার্বেলগুলো প্রতিটি তিন পয়সা দরে তার কাছে বেচলো টোকানি, আবার খেললো এবং যথারীতি খোয়া গেল পরক্ষণেই।
কোনো আক্ষেপ নেই। মার্বেলগুলোর বিনিময়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই দলের কাছে খুব সহজ হতে পেরেছে, এতেই আনন্দ। সে খুশি। যারা হেরে গিয়ে নিঃসঙ্কোচে ফতুর হতে পারে সব বাহবা তো তাদেরই–এই রকমই একটা উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্য করেছিলো ফকিরা।
ফকিরা আর টোকানি বয়েসে কিছুটা বড় দলের মধ্যে। ওরা দুজন তাই সময়-অসময়ে খিস্তি আর গায়ের জোরে আপন-আপন মর্জিমাফিক নিছক স্বেচ্ছাচার চালিয়ে যায়, ছিনিয়ে নেয় অনেক কিছু এবং অনুর চেয়েও ছোটো লাটু গেনদুর মতো অসহায় ছেলেরা সে হামলা প্রতিরোধ করতে না পেরে ব্যর্থ আক্রোশে ফুলতে থাকে। বরং তুলকালাম শুরু হলে অনু মধ্যস্থতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, চেষ্টা করে কোনো একটা সন্তোষজনক মীমাংসায় পৌঁছে দিতে; এখানে আর কিছুই করার নেই তার, যা সে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছের জোরে অনায়াসে চালাতে পারে।
ফকিরারা এখন লামাদের বাগানে ব্রিং-এর পাট উঠিয়ে দিয়েছে। লামার মামা–যিনি রেডিওতে খাম্বাজ হাম্বীর মালহার ইত্যাদি গেয়ে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন এখন আর তিনি জীবিত নন। তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন বলেই লামাদের ছায়াঢাকা বাগানের আনন্দ বাজেয়াপ্ত হয়ে গিয়েছে।
বৃত্তান্তটা ফকিরার মুখ থেকে শোনা।
মরাকাডের কসম কর্যা কতাছি হালার পো হালা পাগলাডা হেইদিনকা আমারে একলাটি পায়া যা তারাডি করছিলো।
ফালানি প্রথমে বিশ্বাস করে নি।
সে বলেছে, গানজা মারোনের আর জাগা পাইতাছস না বুঝি?
ফকিরা নাছোড়বান্দার মতো বলেছে, যা না বে, ঘুইরা আয়না দেহি, হিম্মত আছে নি? পেরথম দেহিকি ভূত হয়া বয়া বয়া চক্ষুবন করা হালার পো হালায় গামা-উমা কয়া কাওয়ালি গাইবার লাগছে। আমার আতে আছিলো এউগা আস্তা মালপো। চক্ষু খুইলা আমারে দেইখাই অক্করে ভান কর্যা আয়া মালপোয়াডা লয়া গেলগা–