দূর পাগল–মার মুখে আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা দেখতে পেয়েছে সে উনিই তো আমাদের ভরসারে বোকা ছেলে। ইশ, উনি না হলে যে কি হতো অনু, ভাগ্যিস পরিচয় হয়েছিলো! চিন্তায় চিন্তায় বোধ হয় পাগলই হয়ে যেতাম।
মায়ের স্যারকে খুব ভালো লাগে। কি সুন্দর মানুষটি, অনু চমকৃত হয়েছে। তার স্কুলের গিলবার্ট প্রামাণিকের (ক্যাচূচিরিয়াস্স্যার) মতো মাথায় একরাশ অবাধ্য ঝাঁকড়া চুল, হাসি হাসি মুখ, চশমা পরেন না। উনি থাকতে অকারণে ও ঘরে যেতে বারণ আছে, যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটে লেখাপড়ার। ভালোমতো ইংরেজি রপ্ত করতে চায় মা। ইংরেজি না জানলে চাকরি জোটানো কোনোমতেই সম্ভব নয়। চাকরির চিন্তা দারুণ নেশার মতো পেয়ে বসেছে মাকে—অনু জানে। বাঁচতে হবে তাদের। পালাতে হবে। মাত্র একদিনই দেখতে পেয়ে হাতের ইশারায় কাছে ডেকেছিলেন, সেই প্রথমদিকে, প্রায় বছরখানেক আগে।
খুব ভালোভাবে আপাদমস্তক খুঁটি জহুরির মতো নিরিখ করে আনন্দিত হয়ে বলেছিলেন, স্ট্রেঞ্জ! এ যে একেবারে বালক হেরম্ব, আই মিন র্যাব। ঠিক তেমনি খাড়া খাড়া ঠাসা চুল, গভীর চোখ, শাণিত দৃষ্টি, যেন জ্যোতি ঠিকরে বেরুচ্ছে, আই ওয়ান্ডার! চুলে বিদ্রোহ, চোখে বিদ্রোহ, চিবুকে বিদ্রোহ, ঠোঁটে বিদ্রোহ
তাকে একপাশে টেনে নিয়ে মা সগর্বে বলেছিলে, ছেলেটি কার দেখতে হবে তো।
পরে আবার জানতে চাইলো হেরম্ব না র্যাবর পরিচয়। স্যার উৎসাহিত হয়ে বলেছিলেন, র্যাশ্যার একজন রিনাউন্ড পোয়েট, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির স্টাইলের প্রবর্তকও বটে। স্তালিনের আমলে ফিল্মের নোংরা গান লেখার অপরাধে খামোকা গুম করে দেওয়া হয় বেচারাকে!
খুবই প্রানোচ্ছল মায়ের স্যার। ভালো লেগেছিলো। প্রাণের ভেতর থেকে কথা বলেন ভদ্রলোক। যেমন উজ্জ্বল তেমনি চঞ্চল, অসম্ভব হাসতে পারেন।
কিন্তু এই ভয়ঙ্কর দুপুরে কি করবে। তার ইস্কুল সেই সকালে। তারপর বারোটার মধ্যে ছুটি। মা স্যারের কাছে ইংরেজি শিখছে একতলার কোণের ঘরে, কাজ শেষ করে ঘাড়ের নিচে লাল গামছা রেখে দরবেশ আলি অকাতরে ঘুমিয়ে, পচার মা গেঁটে বাতলা পা জোড়া রৌদ্রে ছড়িয়ে গালে পান ভরে বারকোশে জলপাই আর আমের আচারের বয়েম সাজিয়ে হুস হুস শব্দে কাক তাড়াচ্ছে, এই দুপুরে কি এমন করার আছে! টুকরো টুকরো দুর্বল ইচ্ছেগুলোকে মাছির মতো তাড়ানো ছাড়া আর কিছু করণীয় নেই, মনে হয় অনুর।
মা যেন কী—
ভাবতে গিয়ে কালো অস্থিরতা তোলপাড় করে। আজকাল খোঁজ নিতে একবারও ওপরে আসে না, দুপুর হলেই তার সঙ্গে যেন নিদারুণ শত্রুতার এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।
শিখছে তো শিখছেই। মার কোনো ক্লান্তি নেই। কতো দূরে সরে গিয়েছে মা। আজকাল প্রয়োজনের বেশি প্রায় কথাই বলে না, দিনের পর দিন অসম্ভব গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে, দ্রুত বদলে যাচ্ছে, অনু শঙ্কিত।
আগে তুচ্ছ ভুল-ত্রুটি নিয়ে পচার মাকে নিছক কম গালমন্দ করে নি, দরবেশ আলিও তো বটেই, আজকাল ওদের দিকে ফিরেই তাকায় না, তুলকালাম তো দূরের কথা; দিনের পর দিন সব অভিযোগ ফুরিয়ে যাচ্ছে।
অনু শিউরে ওঠে। বুকের মাঝখানে কাচের নীল পিরিচ ভেঙে খান-খান হয়ে যায়। মার যাবতীয় সুন্দর অভিলাষগুলো নির্দয় পাথরে পরিণত; এই বাড়ি ছেড়ে, শয়তানের এই থাবা থেকে আর কোনোদিন নিরাপদে পালানো যাবে না। ভয় হয়। তবু এতো ভালোবাসে সে মাকে যে প্রতি মুহূর্তেই উৎকর্ণ হয়ে প্রতীক্ষা করে, রাত্রিবেলা মাঝে মাঝে নির্বোধ শিশুর মতো বিছানা হাতড়ে কি যেন খোজে। তার কেবল ভয়, চিরকালের মতো এক দুয়ে অন্ধকারে একে একে সব মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। মায়ের সব ইচ্ছেগুলো যদি নির্দয় পাথর হয়ে গিয়েও থাকে তবু মনে মনে অনু সেই পাথরটা কেটে টেবিলের ওপরে সাজানো ভাঙা যিশুখৃস্টের মূর্তির চেয়ে অনেক সুন্দর তার রূপ দিতে চেষ্টা করে।
লামাদের বাগানে অনেকক্ষণ ধরে হরিয়াল ডাকছিলো। দুম করে বন্দুকের আওয়াজ ফাটলো এক সময়। ঘেউ ঘেউ করে হুঙ্কার ছাড়লো গরগরে গেস্টাপো। অনু এসে দাঁড়ালো জানালায়, বাগানের ঘাসের পাটিতে তার ছোট্ট একটুখানি শরীর নিয়ে পড়ে আছে প্রাণহীন হরিয়ালটি। ক্যাঙ্গারুর মতো জোড়া পায়ে লাফিয়ে লামার মামা সেটা তুলে নিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দিলো, তারপর ক্রিকেটের বলের মতো দুহাতে লুফে নিয়ে চিৎকার করে উঠলো, হাউজদ্যাট!
লাইটপোস্টের মাথায় কাকের বাসায় আগুন ধরেছে। ওপর থেকে আগুনের ফুলকি ঝরছে ফুলঝুরির মতো।
ময়লা ছেলেরা হৈহৈ করছে।
বাইরে গগনে এক মস্ত আকাশ।
বাইরে ধু-ধু রৌদ্রের মাঝখানে গোল গোল চারকোণা নরম বাগান।
সেইসব গোল চারকোণা নরম বাগানে ছোটবড় অনেক গাছ। ফিকে সবুজ, ঘন সবুজ, নীলচে সবুজ, ধূসর সবুজ সেইসব গাছ অসংখ্য হাত বাড়িয়ে ধরে রেখেছে আকাশ সমুদ্র আর সুবিস্তীর্ণ স্তেপস কিংবা কিরঘিজ প্রান্তরের ছবি, সে রোমাঞ্চিত হয়। সেইসব গাছের পায়ের কাছে পোষ-মানা আদুরে হাতির মতো কান নাড়ছে অঢেল ছায়া। সবুজ উষ্ণীষ জড়ানো সেইসব সাঙ্কেতিক গাছের অসংখ্য বাহুতে বসে নাম-না-জানা সুনীল পাখিরা দিনরাত আকুল সুরে গেয়ে চলেছে।
এইসব বিদীর্ণ দুপুরের মাঝখানে, ধু-ধু রৌদ্রের মাঝখানে, গোল চারকোণা বাগানের চেয়ে, গাছের পাতার চেয়ে, সমুদ্রের চেয়ে, পাখির
গানের চেয়ে, সুন্দর আর ঠাণ্ডা একটি মেঝে পরম নিভৃতে কোথাও আরামে চোখ বুজে অচৈতন্যপ্ৰায় পড়ে আছে জলেশ্বর মালীর মতো। অনুর মনে হলো, জলেশ্বর মালী কতো সুখী!
০২-০৭. পরদিন দুপুরে ঠিক আগের মতোই
০২.