সমবয়েসী ছেলেদের সঙ্গে তার অনেক তফাৎ—অনুর নিজেরই এই রকম ধারণা। নিজের ভেতরে পাথর কেটে কেটে সে নির্জন রাস্তা করে নিয়েছে, ধুলোয় মোড়া সে রাস্তা, ধূম্রজালে ঘেরা, ঘোড়ার পায়ের শব্দ সেখানে বিভীষিকা, এই রাস্তা ধরে নিরাময়ের কল্পলোকে পৌঁছুতে চায়।
মা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। ভাবতে শিখিয়েছে। এখন জানা হয়ে গিয়েছে—ভাবনার ভেতরে কতো রকমেই না মানুষ নিজেকে পায়। ভাবনার ভেতরে নিজেকে সব রকমে যথেচ্ছ পাওয়া যায়। ভয়ঙ্কর যে শত্রু, টলানো যায় তাকেও এবং অতি সহজে। মাকে সবচেয়ে বড় বন্ধু ভেবে তার আনন্দ।
আব্বা অনেক দূরের মানুষ, সুদূর হিমালয়ের ওপার থেকে উড়ে এসে বাড়ির প্রাঙ্গণের ঘোড়ানিম গাছে ভয়ঙ্কর ইচ্ছে নিয়ে জ্বলন্ত বাদুড় ঝুলে থাকলে যেমন মনে হবে। কালো সুটে মোড়া আব্বাকে তার অতিকায় বাদুড় মনে হয়। রাত্রিবেলায় ঘরে ফিরে যখন আলোর তলায় দাঁড়িয়ে চামড়ায় বাঁধানো আইনের বইগুলো টেবিলের ওপর রাখতে থাকেন, যখন জ্বলতে থাকে চশমার পুরু কাচ, তখন দূর থেকে তা দেখে রীতিমতো সে শিউরে ওঠে। তার মনে হয় এই সময় সামনে পড়লে বিদঘুটে অতিকায় বাদুড়টি জ্বলন্ত চোখ আর কালো ডানা নিয়ে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে মার ওপর নিষ্ঠুর উল্লাসে।
হয়তো খুশির ভান করে—অনুর এই রকমই মনে হয় সাধারণত টাইয়ের ফাঁস আলগা করতে করতে মাকে ডেকে বললেন, একটা শক্ত খুনের আসামীকে বেকসুর খালাস করিয়ে এলুম!
ভালো–
এইটুকু বলে চলে এসেছে মা। মা কতো বীতশ্রদ্ধ ওই ছোট্ট একটুখানি ভালো ছুঁড়ে দিয়ে চলে আসা থেকে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে সে। পরদিন দুপুরে—যখন কেউ কোথাও নেই, কার্নিশে শুধু একটা কাক, কালো পাথরের ভাঙা যিশুখৃস্টের মূর্তির গায়ে ফর্শা টিকটিকি, তখন মা ফিশফিশ করে বলেছে খুনিদের সর্দার। চোর ডাকাত ঠ্যাঙাড়ে গুণ্ডারা তোর আব্বার জোরেই টিকে আছে, কতো টাকা নিয়ে আসে তুই তো আর তা জানিস না। সব লুটতরাজ করা টাকা, মানুষ খুন করা টাকা–
পুলিশে ধরে না কেন?
চুপ, তুলবি না ওকথা। আমরা কেউই রেহাই পাবো না, না আমি, না তুই। জেলে পুরবে সবাইকে যদি জানাজানি হয়। ঘানি টানাবে, আঁতা ঘুরিয়ে পাথর ভাঙাবে। এই নোংরা ডাস্টবিন থেকে পালিয়ে যেতে হবে আমাদের। একদিন না একদিন পুলিশে ধরবেই!
বাড়ি থেকে পালানো কতো আনন্দের, অনু বারবার রোমাঞ্চিত হয়েছে। বনে-পাহাড়ে, পদ্মার নির্জন কোনো কলাগাছ ঘেরা চরে, জেলেদের ছোট্টো কোনো গ্রামে—যার চারপাশে কেবল থৈথৈ পানি—পালালে এইসব জায়গাতেই যাবে। তা না হলে এমন কোথাও যেখানে সকলে চিৎকার করে কথা বলে, ঘাসের বিছানায় ঘুমায়, যেখানে আঠারো কিংবা উনিশটা রাক্ষুসে হাঁ-র মতো ঘর নেই, বিশাল উঁচু ছাদ নেই, যেখানে বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম, হু হু হু হু বাতাস বয়ে যায়। মা যদি চিৎকার করে বলে অ-নু-বে-শি-দূ-র-যে ও-না-আ-আ-আ তাহলে সে চিৎকার শাঁ-শাঁ আকাশের দিকে ছুটে যাবে, ধরবে বিদ্যুৎ, তারপর সেই বিদ্যুৎকে চাবুকের মতো হাতে নিয়ে সপাং সপাং মারবে আর পোষ-মানা লোমশ সিংহের মতো বনরাজিঘেরা গ্রাম কেশর নেড়ে নেড়ে খেলা দেখাবে, থেকে থেকে উঠবে গর্জন–
এমনও হয়েছে, সন্দেহ-সঙ্কুল কণ্ঠে মাকে বলেছে,—সে রকম আব্বাকে তো মনে হয় না, মনে হয় কতো ভালো, কি ঠাণ্ডা! লামার আব্বার মতো হাম্বিতম্বি করে ধুম-ধাড়াক্কা মার লাগান না। তোমার সঙ্গে যে ঝগড়া করে তা-ও না!
মা উত্তর দিয়েছে-ঐখানেই তো যতো গণ্ডগোল! কেন ডিটেকটিভ বইগুলোয় পড়িস নি, খুনি-ডাকাত ফন্দিবাজ লম্পটগুলো কি চমৎকার ছদ্মবেশ ধরে সাধারণ মানুষের চোখে বেমালুম ধুলো দিয়ে বেড়ায়, ও হচ্ছে সেই জাতের মানুষ। ভালোমানুষিটা হচ্ছে খোলস, ওটা ওপর ওপর। যে কোনো সময় গলা টিপে মারতে পারে, যে-কোনো সময় বিষ দিতে পারে, সবকিছুই ওর পক্ষে সম্ভব। এখানে থাকলে এমনি করে মরে যাবো, কাকপক্ষীও জানবে না, কেউ কাঁদবে না
নতুন করে আবার সবকিছু ভাবতে হয়।
তোকে আমি কিছুতেই মরতে দেবো না বলতে থাকে মা, অনু চুপচাপ শুনে যায়—তুই জানিস না কি সাঘাতিক তোদের বংশের মানুষরা। তোর দাদা ছিলো ঠ্যাঙাড়েদের সর্দার। চরের মানুষ। কথায় কথায় মানুষ খুন। নিত্য-রোজ গায়ে রক্ত মেখে ঘরে ফিরতো, আর সারা। গায়ে সেই রক্ত নিয়ে মাটির সানকিতে ভাত খেতো। এক চাচাকে তোর সেই দাদী বুকের ওপর চেপে বসে ভোতা কাস্তে দিয়ে পুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জবাই করেছিলো, সে কী চিকার! ঘড়ঘড় করে রক্ত তুলতে তুলতে সকলের চোখের সামনে মরে পড়ে রইলো, ভয়ে কেউ ছুঁলো না পর্যন্ত, গোর দেওয়া তো দূরের কথা। শেষে, দুদিন পর যখন পচে দুর্গন্ধ হয়ে গিয়েছে লাশ তখন শেয়ালে টেনে নিয়ে গিয়েছে একদিকে। পরদিন টেনেহিঁচড়ে খেয়েছে শকুনেও।
আতঙ্কিত অনু আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে। মা অভয় দিয়ে বলেছে, সেই জন্যেই তো ইংরেজি শিখছি, তোকে নিয়ে আমি কোথাও চলে যাবো, চাকরি করবো। তোর ধুরন্ধর আব্বা টের পাবে না।
স্বস্তি পেয়েছে শুনে। একথায় ভয় কেটে গিয়েছে।
মার মুখে সে একথাও শুনেছে—ঐ যে স্যার যিনি আমাকে রোজ পড়াতে আসেন, উনি কিন্তু আমাদের খুব বিশ্বস্ত বন্ধু। সব জানেন উনি। আমি সব বলেছি ওঁকে। খুব ভালো লোক, উনি সাধ্যমতো আমাদের সাহায্য করবেন। তোকেও খুব ভালোবাসেন।
অনু ভয়ে ভয়ে বলেছে, আর যদি সব ফাঁস করে দেন?