সরু রাস্তা এক জায়গায় এসে গোল হয়ে দুদিকে চলে গিয়েছে, মাঝখানে একটা একচালা ঘর, যেন ঋষিপাড়া দুধের হাড়িধরা লোহার বাউলি দিয়ে ঘরটাকে ধরে রেখেছে। ছেলেটা বললে, এটাই সরুদাসীদের ঘর। ইশ, যা নোংরা ওরা, একেবারে হোপলেস অবস্থায় থাকে!
এখানে-ওখানে বাসক আসশ্যাওড়া আর বনহলুদের ঘুপসি ঝোপ। মাদারগাছের খুঁটি। ঘরের সামনে উঠোন। উঠোনের কোণে গাঁথুনি খসে পড়া ইন্দারা, পাশে বাঁশের খুঁটিতে দড়িবাঁধা বালতি ঝোলানো। করমচা গাছের কোণ ঘেঁসে চুপড়িআলুর লতা বাতাসে দোল খাচ্ছে। একপাশে শুকনো ছাগলের নাদি ভঁই হয়ে পড়ে আছে।
উঠোনের একপাশে ইন্দারার খুব কাছাকাছি হাড়িচর্মসার এক বুড়ি ক্ষুদ কাঁড়িয়ে কাঁকর আলাদা করছে; শনের নুড়ির মতো চুল, একটাও দাঁত নেই, আর ঘরের বারান্দায় একজন শীর্ণকায় থুথুড়ো বুড়ো শাদা ধবধবে ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল নেড়ে বিভোর হয়ে একমনে পাখখায়াজ বাজাচ্ছে। বুড়োটাকে অনুর যিশুখৃস্ট মনে হলো। তার ঘরের সেই টেবিলে সাজানো ছোট্ট মূর্তিটার মতোই পেটে ভাঁজ, পাঁজরের প্রতিটি হাড় সহজে গোনা যায়, ঋষির মতো দাড়িগোঁফ।
ছেলেটা বললে, এই তো সরুচামারনী। যাওনা লজ্জার কি আছে। না হলে আমিই গিয়ে সব বলছি, আমাকে তো ওরা ভাল করেই চেনে। কি বলবো কি, ব্যথা উঠেছে?
অনু বিভ্রান্তের মতো মাথা দুলিয়ে বললে, না না, এ সে সরুদাসী নয়—
ছেলেটা অবাক হয়ে বললে, তাহলে সে আবার কে?
সে আমাদের মতোই ছোটো! অনু ঘড়ঘড় করে বললে, বাবুদের বাগানে সে হরিয়ার সঙ্গে রোজ খেলা করে বেড়ায়।
কি আবোল-তাবোল বকছো তুমি! ছেলেটা মুখ বেঁকিয়ে বললে, হরিয়াকে নিয়ে বুড়ি আবার কি খেলবে, ওর তো আর মাথা খারাপ নয়! হরিয়াই তো ওর স্বামী! ঐতো ট্যাগরা গাঁজাখোরটা বসে বসে বাজনা প্রাকটিস করছে!
যে উঠোনে অনু দাঁড়িয়েছিল এতোক্ষণ এখন সেটাকে যারপরনাই ভয়ঙ্কর বলে মনে হলো, উঠোনটা একটা ঘেয়ো জিভ। হা হয়ে জিভ বের করে রেখেছে কুটিল ঋষিপাড়া। মনে হলো বাঁশের খুঁটির গায়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে বালতিটা। উঠোনে ওপরের ছায়াময় লালচে আলো অসম্ভব থমথমে, বুঝিবা এক করাল বিভীষিকা। তীক্ষ্ণ বর্শার খোঁচার মতো সহসা মনে হলো অনুর পায়ে পায়ে এক কুটিল ষড়যন্ত্রের মাঝখানে অগোচরে এসে পড়েছে সে; ফণা ধরে আছে এক কালকেউটে, ছোবল। মারবে, একটু পরেই দাঁতে কাটবে তাকে।
খুব জোরে বাজাচ্ছে বুড়ো হরিয়া। আগের চেয়ে জোরে, আরো মাথা নেড়ে, বাবরি ঝাঁকিয়ে, এ-হে-আই হাঁক ছেড়ে, ধোঁয়াচ্ছন্ন এক কুহক থেকে ঘুটঘুটে করাল আরেক কুহকে উন্মাদপ্রায় যাত্রারম্ভ করেছে সে। পাখোয়াজের গায়ে প্রতিটি চাটির ভেতর সাবধান সাবধান ধ্বনি চড়বড়িয়ে উঠছে। রনোন্মত্ত হস্তিযূথকে দাবড়ে দিচ্ছে সে। হাতের চাঁটি এবং পাখোয়াজের উদ্ধত ধ্বনি এবং ঘনঘন এ-হেই–আই—ও–হুঁহ্ ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে চলেছে। অভিশপ্ত ভূগর্ভের কালো খোল ফেটে পিচকারির মতো তীব্রভাবে উদগীরিত হচ্ছে সেই মদোন্মত্ত ধুপধাপ শব্দলহরী। চিড় খাচ্ছে আর দুড়ুম-দাঁড়াম করে সেখানে সমানে স্থানচ্যুত হচ্ছে কঠিন শিলাস্তর, উত্তপ্ত এবং লেলিহান অগ্নিশিখার মতো হলহলিয়ে উঠছে প্রচণ্ড এবং ক্রোধান্ধি তুমুল শব্দরাজি; সাবধান এবং ধ্বংস এবং বজ এবং মাতঙ্গ এবং গাণ্ডিব এবং ব্যাঘ্র এবং হলাহল এবং সিংহ এবং ভুজঙ্গ এবং বৃষ এবং খড়গ প্রভূত শব্দাবলি সেই দুর্দম অগ্নিশিখার মাঝখানে। আতসবাজির মতো মুহুর্মুহু ফেটে পড়ছে। অনুর মনে হলো বুড়ো হরিয়ার হাতের এই প্রলয়ঙ্কর পাখোয়াজ নিঃসৃত শব্দবাণে পৃথিবীর যাবতীয় সভ্যতা ভেঙে চুরমার, খানখান হয়ে যাবে। রক্তবৃষ্টি। মাংসবৃষ্টি! অগ্নিবৃষ্টি। রক্তমাংস অগ্নিবৃষ্টি!
পেছনে কয়েক পা সরে এসে বিভ্রান্ত অনু বললে, চলো এখান থেকে, এ তুমি কোথায় নিয়ে এলে! এখানে অন্য সরুদাসী! এখানে অন্য সরুদাসী!
উর্ধ্বশ্বাসে ফিরে যাবার পথে বারবার অনুর মনে হলো, জারজ নিনাদে উন্নীত পাথোয়াজের উত্তরোত্তর দ্রুততর উত্তাল ফেনিল তরঙ্গমালা পিছন থেকে পরাক্রান্ত ঘাতকের মতো তেড়ে আসছে তার দিকে।