খুব অবাক হলো, কেননা পথটাও তার চেনা হয়ে গিয়েছিলো; কোথায় ডানদিকে লাল লেটারবক্স, কোথায় রেশন শপ, কোথায় ভাঙা গাড়ি পড়ে, সবই মনে আছে এবং সবকিছুই হিশেবে মিলে যাচ্ছে, কেবল চেলাকাঠের সেই দোকানটা কোথাও নেই।
নারকেলের বালদোর ওপর ছোট্ট একটা বাচ্চাকে বসিয়ে কতোগুলো ছেলেমেয়ে পাতার ঝুঁটি ধরে টেনে টেনে গাড়ি-গাড়ি খেলা খেলছিলো। অনু তাদের একজনকে জিগ্যেস করলো, ঋষিপাড়া কোন্দিকে?
সপ্রতিভ একটি ছেলে এগিয়ে এসে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বললে, ঐ তো সামনেই!
অনু জিগ্যেস করলো, সরুদাসীদের ঘর চেনো?
খুব চিনি! কতোবার ওদের বাসায় গেছি। আমার মা চামারনী দিয়ে তেল মালিশ করাতো কিনা! চলো না, দেখিয়ে দেবোখন। ছেলেটা চোখ নাচিয়ে বললে, তোমার মায়ের ডেলিভারি হবে বুঝি? ব্যথা উঠেছে?
অনু খুব বিব্রতবোধ করলো।
নিজ থেকেই ছেলেটা অনর্গল কথা বলে যেতে লাগলো ঋষিপাড়ার পথে। বললে, আমার মা বলেন ডাক্তারদের থেকেও এদের অনেক বেশি নলেজ। ডাক্তাররা স্রেফ ধোকা দিয়ে পয়সা নিয়ে যায়। আর এরা বাচ্চা খালাস করতে করতে নাড়ি-নক্ষত্র সব বুঝে ফেলে। পয়সাও কম লাগে। পাঁচটা টাকা, দুএকটা ঘেঁড়া পেটিকোট-শাড়ি, সের দেড়েক চাল, ব্যাস, এতেই ওদের পায় কে! আমার বড় বোনের সেবার এমন ব্যথা চাগালো যে ডাক্তার কবিরাজ সব ফেল, শেষে চামারনী বেটি এসে যেই না চুলের গোছা মুখে দিয়েছে
ঋষিপাড়ায় পৌঁছে সবকিছু নতুন মনে হলো অনুর। কেমন এক মাটিতে নুয়েপড়া নিস্পৃহ চেহারা এই পাড়াটার; সরল, সহজ, বৈরাগ্য-ক্লান্ত, অথচ পরম পরিতৃপ্ত আলোর ভেতর ধ্যানস্থ হয়ে আছে। অভিভূত হবার মতো নয়, কিন্তু এমন কোনো নরোম স্নিগ্ধ নিস্তব্ধতা আছে এখানে যা পরাক্রান্ত শহরের বুকে অন্য কোথাও নেই।
এখানে ওখানে চকমিলান বস্তি। বাখারি মাটি আর খোলার ঘর। একপাশে হাজা-মজা নীল সরপড়া নিস্তরঙ্গ জলাশয়। ধস নেমে মাটির চাঙড় কাত হয়ে আছে। অনুর মনে হলো পৃথিবীর সব স্রোত ঐ নীল জলাশয়ের নিথর তলদেশে বহুকাল আগে মাছের এক একটি হলুদ ইচ্ছের মতো হারিয়ে গিয়েছে।
যতোই এগোতে থাকে ততই বিস্মিত হয়। দুচোখ ভরে যায়। তাকে দেখে ধীরে ধীরে নিস্পৃহতা কেটে যাচ্ছে ঋষিপাড়ার। কলরবহীন প্রশান্ত বাতাসে সুনীল পাতার রাশ আলগা করে কয়েকটা বিহ্বল বেলগাছ উদ্ভ্রান্ত পাখির চিৎকার জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
খঞ্জনা ডাকছে।
খঞ্জনা আর খোকাহোক।
বাছুরের গলায় ঘুঙুর বাজছে। নাটাবনে ঝুমঝুমি বাজাচ্ছে ঘর পালানো বাতাস। খোকাহোক ডাকছে। পা লম্বা করে, মাটির ঝুরঝুরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দূরে আবছা মেয়েমানুষ, সুই-সুতোয় ছেঁড়াফোঁড়া রঙ-বেরঙের তালিমারা আকাশের মতো নীলকাথা সেলাই করছে।
গোবরগাদার কোলে ফুলের ভারে নুয়েপড়া ঝুমকোলতা বললে, অনু, আমার নাম মঞ্জুশী, লটপটে বিনুনি দোলানো বিকেলের মতো আমিও আমিও আমিও তোমার হাত ধরে, তোমার সঙ্গে। তালশাঁসের হিম মাংসে আমাদের ছেলেমেয়েরা কি-না সুখী! বুকের আলুথালু আঁচলের চেয়েও আমাদের সব রাস্তা নিস্তব্ধ, ধ্বনিপুঞ্জ থেকে পা হড়কে পিছলে আসা; সবুজ ঘাসের নিরহঙ্কার গন্ধে নিয়তই গুমরে উঠছে এইসব ধুলোয় নরোম রাস্তা।
এসো, তোমার গলায় আকন্দফুলের মালা পরিয়ে দেবো, স্বর্ণলতিকার ভারে নুয়ে পড়া রক্তজবার গাছ বললে—–আমাকে তুমি ফুল্লরা বলেই ডেকো, আমি তোমার গলায় আকন্দফুলের মালা দেবো, আর একলক্ষ মৌমাছির বিবর্ণ দুঃখের চেয়েও বড় বড় নীল ঘাসফুল, যতো নিতে পারো, যতো নিতে পারো।
রাঙারৌদ্র আমার ঠোঁট, বিকেল আমার বিনুনি, মঞ্জুশ্রী ফুল্লরা এরা আমার বোন, ঋষিপাড়া স্বয়ং ফিশফিশ করে উঠলো এইবার—আমাদের ঘাসের সবুজ জ্যোছনায় গঙ্গাফড়িং আর ঝিঝিপোকা তুমি, এখানে প্রজাপতির ঝাক নামে, এক দুই তিন চার গুনতে চেওনা, তা অসম্ভব, লক্ষ লক্ষ, প্রজাপতি প্রজাপতি প্রজাপতি প্রজাপতি, তুমিতো প্রজাপতি ভাল বাসো। ফণিমনসার মতো মুখ এখানে পাবে না। চাঁদের আলোয় ভরাবুক মালীবৌ এখানে সবাই। ভিজে সপসপে লাল গামছা চোষা ঝঝ রোদ নেই, এখানে খঞ্জনা পাখি, বাবুদের বাগান থেকে পালিয়ে আসে শিকল হেঁড়া ময়ুর, এখানে খঞ্জনা পাখি, আসে তিতির, ঝুঁটিওলা সুখের পায়রা, এখানে খঞ্জনা পাখি, ঐ শোনো খঞ্জনা ডাকছে,–এসো, তুমি আমি ফুল্লরা সকলে হাত ধরাধরি করে সবুজ ঘাসবনে নেচে বেড়াই, ঘাস ঘেঁটুবন আসশ্যাওড়ার বন ঘৃতকুমারীর বন এসো দেখবে এসো, ঘোড়ানিমের ডালে নিমপাখির লুকোচুরি খেলা দেখছে আমাদের সব বিশুয়ালাল আর হরিয়া, দাদাপাখির খসা পাখনা বাবুই পাখির বাসা পেতলের ভাঙা আংটি কাচের ভাঙা লাল নীল সবুজ চুড়ি সুগোল নুড়ি ইঁদুরের দাঁতের মতো একরত্তি বেলে ঝিনুক ন্যাকড়ার পুতুল টিনের কৌটো কি কি চাই তোমার, আমাদের সব ফুল্লরা আর মঞ্জুশ্রী সকালে জলা থেকে চুপড়ি বোঝাই করে কলমিলতা তুলে আনে, আমাদের সব বিশুয়ালাল ন্যাংটো হয়ে ব্যাঙের মতো ঝাঁপ দেয় কলমির বনে, আমাদের সব হরিয়ার কোমরের ঘুনসি কেটে যায়, নুনু দেখাদেখি খেলা শেষে রোজ কুরকুটি দিয়ে হেসে ওঠে, ছাগলের পেছনে ছোটাছুটি করে তার গলার নুড়ি ধরে টানে, চালকুমড়োর চুনে পাজর এঁকে ভূতের ভয় দেখায়, অনু এখানে খঞ্জনা পাখি, এখানে খঞ্জনা পাখি–
অনুর মনে হলো, পৃথিবী উজাড় করে আমি ঋষিপাড়ায় হীরের মিছরি নিয়ে এসেছি।