তারপর, তারপর মা এক ফুৎকারে তার চিৎকারের প্রদীপটাকে, তার চিল্কারের লীলাচঞ্চল নীল শিখাকে নিস্তব্ধ করে দশ লক্ষ কালো চাদরে ঝিনুকের ঝরনা ঢেকে দিলো।
১১. সেরে ওঠার পর
সেরে ওঠার পর প্রথমেই অনুর মনে হলো যেমন করেই হোক সরুদাসীকে তাঁর খুঁজে বের করতেই হবে। বুকের ভেতর একটা আধলা ইট আটকে আছে। কতো দিন আমি রুগ্ন বিছানার উপর শুয়ে আছি, অনুর মনে তোলপাড় করতে লাগলো, কতোদিন হয়ে গেল আমি রক্তশূন্য শাদা কাফনের উপর পড়ে আছি, কতোদিন হয়ে গেল আমি সরুদাসীকে খুঁজি নি, কতোদিন যে হয়ে গেল আমার আকাশ নেই, শুধু গা পোড়া জ্বর!
ফেলে আসা এক একটি ধূসর দুপুর তাকে হাতছানি দেয়; প্রথমে পায়ে পায়ে, সন্তর্পণে, তারপর নির্বোধ চঞ্চল বালকের মতো ছায়ানৃত্যে।
রক্তমাংসহীন আমি পড়ে আছি, কেউ নিদারুণভাবে গুম করে দিয়েছে আমাকে, অসহায়ভাবে মনে হয় তাঁর ছিন্নমস্তার মন্দিরের পুরোহিত নীরবে ভ্রুকুটি করে চলেছে আমাকে, কানের চারপাশে রহস্যনীল ফিশফিশ, ঘর তো নয় একটা এ্যাকোয়ারিয়াম, ফুলে ঢোল একটা মরা মাছের মতো পড়ে আছি তার ভেতর।
মনে পড়ে সেই সব দুপুর, প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো মেঘের গুহা থেকে বেরিয়ে আসা সব রৌদ্র, জ্যোতির্ময় একটি শিশু কেমন হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায় আকাশময়, মেঘের কুটি একদিন, এক একদিন মাদল বাজায় মেঘ, ঝরঝর ঝাঁপতাল ঝিঝি ঝিঝিট, তারপর কি বিশাল কি অপার নিস্তব্ধতা, নিস্তরঙ্গ নিরাকার নিস্তব্ধতা; সাত কোটি বছরের এক আস্ত আকাশ হয়ে যায়, নির্ভার!
সরুদাসীকে তার খুঁজে বের করতেই হবে। মেঘের গুহা থেকে নিপাট রৌদ্রের মতো যদি বেরিয়ে আসে সরুদাসী, থরে বিথরে সাজানো যাবতীয় বিষণ্ণতার উপর ছিটিয়ে দেবে ফুলের পাপড়ি।
অনেকদিন থেকেই মায়ের স্যার আর আসেন না।
মায়ের ইংরেজি শেখা একেবারেই বন্ধ।
এসব নিয়ে অনুর কোনো মাথাব্যথা নেই, চুলোয় যাক সবকিছু। এখন সে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে।
অসুখের পর থেকে নিজের বদল দেখে নিজেই চমকে যাচ্ছে। নিজের কাছেই কতো অচেনা এখন। মার উপর তার আর বিশ্বাস নেই কোনো। মা কোনোদিন পালাতে পারবে না এ বাড়ি ছেড়ে, সবই মিথ্যে প্রবোধ ছিলো এতোদিন।
তাকে পালাতে হবে একাই, আর সেই জন্যেই কপাল খুঁড়ে, পৃথিবী খুঁড়ে, আলো নিংড়ে নিংড়ে যেমন করেই হোক সরুদাসীকে তার খুঁজে বের করা চাই-ই। সে মনে মনে আওড়াতে থাকে, তোমরা আমাকে আটকে রাখতে পারবে না, ছাদের নিচে আমি হাঁপিয়ে উঠি, একা একা আমি মরে যাই, তোমাদের অনু মরে যায়, এ্যাকোয়ারিয়ামের ভেতর আমাকে ঠুকরে করে খায় জ্যান্ত মাছেরা।
জানালার গম্ভীর নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে তার বুকের ভেতরের খবর পেলো অনু, সেখানে দাঁতাল পশুর মতো এক আক্রোশ মুখ গুঁজে নির্জীবপ্রায় পড়ে আছে, জনহীন ফাঁকা হলঘরে হাহাকারের প্রতিধ্বনি উচ্ছিষ্ট টুকরো টুকরো শব্দ পাখিরা ঠোঁটে করে নিয়ে গিয়েছে মৌনতার ধ্যানগম্ভীর শিখরে। লামাদের বাগানে আমগাছের নিচে সেই অতিচেনা আদুরে ছায়া পরম আলস্যভরে জলেশ্বর মালীর মতো গাল পেতে শুয়ে আছে।
পাতার ফাঁক দিয়ে পালিয়ে আসা শাদা রুমালের মতো রৌদ্র এক এক চিলতে ছায়ার কোমল মাদুরে এখানে ওখানে ছড়ানো।
ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া একটা মুখোশ কি?
না কি গুলির ঘায়ে এমনভাবে চিরে গিয়েছে ছায়ার চাদর?
তা না হলে সুখী চিতলমাছের ঝাঁক নেমেছে ছায়ায়!
চিতল কিংবা ইলিশের ঝাঁক; মাথার উপর দিয়ে বিশাল এক পদ্মা নদী বয়ে চলেছে।
মা বাইরে যাচ্ছিলো। আব্বা বারান্দার রেলিং ধরে ঝুঁকে বাগানের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। বহুদিন যাবৎ তিনিও শয্যাগত। চেনা যায় না। খুব খারাপ হয়ে গিয়েছেন।
জিগ্যেস করলেন, কোথায় যাচ্ছো?
স্যারের কাছে!
না ষাঁড়ের কাছে?
সোয়াইন! মা বেপরোয়ার মতো দপদপ করে পা ফেলে ঝটকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললে, চামার!
মা চলে গেল। মার রিকশা অদৃশ্য হলো আড়ালে। অনুর মনে হলো সে যখন চলে যাবে তখন ঠিক এই রকমই একটা কিছু হবে। রাস্তায় এখনকার মার মতোই কয়েক মুহূর্ত শুধু দেখা যাবে, তারপর এই বাড়ি থেকে আর কেউ দেখতে পাবে না তাকে, ঠিক মার মতোই এক মিনিটের মধ্যে গলির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাবে সে। এই বাড়িটার আর কোনো অর্থ থাকবে না তার কাছে তখন।
জানালা থেকে সরে এসে অনু প্রথমে রেজমিতে পকেট বোঝাই করলো, তার কাছে এগুলো আকাশের তারা। পরে মার ঘরে ঢুকলো। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে তিলধরা একটা বড়ো কড়ি নিলো যা কানে চেপে ধরলে সমুদ্রের অবিশ্রান্ত শোঁ-শোঁ শব্দ শোনা যায়। একজোড়া শ্যাওলা আকিক নিলো, ঘষলে যার গায়ে অন্ধকারের এক একটা সুন্দর ইচ্ছের মতো ফুলঝুরি ঝরে। আর নিলো ফসফরাসে চোবানো একজোড়া আঙুরথোকা। দুল, রাত্রিকালে যা এক একটা দুঃখের মতো জ্বলবে।
ঐসব পকেটে ভরলো। মনকে খুব শক্ত করে নিলো সে। এক সময় বেরিয়ে পড়লো। আজ সে ঋষিপাড়ায় যাবে।
জ্বালানি কাঠের সেই দোকান, বৃষ্টির তুমুল তাণ্ডবে ভারি দমকা হাওয়ার হাত ধরে আমি আর সরুদাসী—সরুদাসী আর আমি, দুজন আমরা, সোনার কাঠি দিয়ে বোনা ঝাঁপ ঠেলে যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম, প্রথমে সেইখানে, অনু মনে মনে এইসব ভাবলো।
নিঃসঙ্গ সাক্ষীর মতো একটা আমগাছ দাঁড়িয়ে। মা মরা একটি ছেলে যেন সজল নয়নে আকাশের কাছে কোলভিক্ষা করছে।
স্পষ্ট মনে আছে অনুর ঝাপ ঠেলে ঢুকবার সময় এই গাছটা পলকের জন্যে তার চোখে পড়েছিলো সেদিন, কিন্তু ঢেউটিনের ছাউনি দেওয়া সেই চালাঘর দোকানটা কোথাও খুঁজে পেল না সে।