বিবেক আবার কি? এক কানাকড়ি দাম আছে নাকি তার? তোমাদের নিজেদের বিবেক এতোদিন কোথায় ছিলো? কেন, রূপসী সতী বিধবা বোনটির সব বৃত্তান্ত কি জানতে না, তবু কানে তুলো দিয়ে চোখে ঠুলি বেঁধে ঘাড় গুঁজে ছিলে কেন এতোদিন, তখন তোমাদের ধােপা কাচানো বিবেক কোথায় ছিলো? আমার একার বেলায় কেন বিবেকের প্রশ্ন? কোন্ বিবেকে। তোমার সতী-সাধ্বী বোন আত্মীয়-স্বজনের মুখে কালি দিয়ে ঘরে জোয়ান ছেলেদের আড্ডা জমতে দিয়েছে এতোদিন, কোন্ বিবেকে আস্কারা দিয়েছে? বিবেক! বোনের শতেক কেচ্ছা শোনার পরও চিরটাকাল হাবা কালার মতো চোখ নাক কান বন্ধ করে পড়ে রইলে কেন, তখন তোমার এতো সাধের কর্তব্যবোধ কোথায় ছিলো, শিকেয় তুলে রেখেছিলে? কোথায় ছিলো তখন বিবেক? বিবেক!
মুখ নিচু করে বসে রইলেন আব্ব। সম্ভবত আহত হয়েছেন। অনুর কাছে পরিস্থিতিটা নিদারুণ মনে হলো। মাকে এতো উত্তেজিত হয়ে পড়তে আর কখনো দেখে নি সে। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। একটানা অনেক কথা বলার পর শ্রান্তিতে ভেঙে পড়ছে, বিপুল বেগে দম নিতে হচ্ছে মাকে। সবকিছু মিলে কি প্রাণান্তকর পরিস্থিতি!
তোমার মুখ থেকে কর্তব্য বিবেক এসব বড়ো বড়ো বুলি শুনলে আমার পা থেকে মাথা অব্দি রিরি করে জ্বলতে থাকে। আমার বেলায় তোমার ঐসব কর্তব্য বিবেক চিরকাল বাক্সবন্দী ছিলো। কি পেয়েছি আমি তোমার সংসারে এসে? কি এমন দিয়েছো তুমি আমাকে? কোনোদিন ভুল করেও তো একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখো নি আমার দিকে; কি আমার ছিলো, কি আমার আছে। আমি তোমার দুচোখের বিষ, তোমার শত্রু; এর বেশি আর কিছু ভাবতে পারো নি কখনো। এটা কি একটা জীবন? প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কি দিতে পেরেছো আমাকে, আর এই নিয়েই আহাদে আটখানা হতে হচ্ছে আমাকে, চোখে আঙুল দিয়ে সবাইকে দেখাতে হচ্ছে কতো সুখে রেখেছো তুমি আমাকে–
তোমার এইসব কথার কোনো মাথামুণ্ডু আমার মাথায় আসে না। মনগড়া দুঃখের কোনো ওষুধ নেই। সবসময়ই দেখে আসছি কোনো দরকারি কথা পাড়লেই চিরাচরিত নিয়মে তুমি এইসব বাক-বিতণ্ডার ঝড় তুলে সবকিছু ঘুলিয়ে ফেলতে থাকো। কিচ্ছু বুঝি না এসবের–
বুঝবে কি করে, বোঝার দরকার থাকলে তবে না!
এ ব্যাপারে আমার আর কিছু বলার নেই।
সে-ই ভালো। নিছক মন রাখবার জন্যে আমার মতামত না নিয়ে করে নিজের মরদতোলানি বোনকে মাথায় নিয়ে ধেই ধেই করোগে যাও! ও আমি আগে থেকেই জানি।
ওর কথা আবার কেন, ওর সম্পর্কে তোমার যা বলার তুমি তো বলেই দিয়েছে, যাতে না আসে সেই কথাই লিখবো!
অনু দেখলো হঠাৎ খুব স্বাভাবিক হয়ে গেলেন আব্বা; অস্বাভাবিক রকম স্বাভাবিক, যেন এইমাত্র মামলায় জিতে হাওয়ার ভেতর দিয়ে ঘরে এসে পৌঁছেছেন।
আমি তা বলতে যাবো কেন, জীবনভর তোমার খোঁটা খাবো বলে?
খোঁটা দেবো কেন–নাছোড়বান্দার মতো কথাগুলো আব্বার মুখ থেকে আদায় করে নিলো মা, তোমার সংসার, দরকার মনে করলে আমাকেও বাতিল করে দেবার অধিকার তোমার আছে! আব্বা হেসে খুব নরোম করে মাকে বললেন, উঠো না, বোসো, আসল কথা এখনো বলা হয় নি। ভাবছি হাটখোলার বাড়িটা এবার বেচে দেবো। দাম পাওয়া যাচ্ছে ভালোই, তাছাড়া শুধু শুধু চেম্বারটা ওখানে ফেলে রাখাও আমার কাছে কাজের কাজ মনে হচ্ছে না। এখানে একবার ওখানে একবার, এ আর ভালো লাগছে না। পেরেও উঠছি না। ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারও অনেক ঝামেলার, ঝক্কি-ঝামেলা লেগেই থাকে বছরভর। ওসবের মধ্যে আর যেতে চাইনে, তুমি কি বলো?
কোনো উত্তর দিলো না মা প্রথমে। তারপর কি ভেবে নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে বললে, তোমার বাড়ি তুমি বুঝবে, আমি ওসবের কিছু বুঝি না। থাকলেই বা আমার কি না থাকলেই বা আমার কি, এসব ধ্যাষ্টামি না?
আব্বা দুঃখিত হয়ে বললেন, দূর থেকে গা বাঁচিয়ে কথা বলাটা একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে তোমার। আমি যেন চিরকাল স্রেফ প্রতারণাই করে এসেছি তোমার সঙ্গে, তুমি এমনভাবে কথা বলো। বাড়ির ব্যাপারে কোনো মতামত নেই, রানির কথা জিগ্যেস করলুম, সেখানেও ঐ ধোয়াটে ধোঁয়াটে কথা। তোমার নিজের বোন হলে কি করতে?
নিজের বোন হলে শত দুর্বিপাকেও অন্তত তোমার এই হ্যাংলামুখো সংসারে এনে ভেড়াতুম না। বুড়ো বয়েসে নতুন করে যেন আবার প্রেম চাগিয়ে উঠছে তোমার। বাণীবুকে দেখলে তোমার আর মাথা ঠিক থাকে না, এতো কথাও বলতে পারো, মুখও ব্যথা করে না তোমার। আর ও নচ্ছার মাগীও কম যায় না, থেকে থেকে যেন চাগিয়ে উঠছে, একেবারে জোকের মতো লেগে থাকে–
আব্বা নিস্পৃহ কণ্ঠে বললেন, দ্যাখো, ইডিওসিরও একটা সীমা থাকা দরকার, ছি ছি। এতো নিচ তো তুমি কোনোদিনই ছিলে না!
আর ন্যাকা সাজতে হবে না, তোমায় আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। চোখ বন্ধ করলে এক্ষুনি একটা ডবকা ছুঁড়ি নিয়ে আসবে নাচতে নাচতে। আমি ঢের সহ্য করেছি, আর নয়। তোমাকে শাসন করার যথেষ্ট অধিকার আমার আছে।
অস্বীকার করছিনে, কিন্তু সবকিছুর পিছনে কারণ থাকতে হবে তো?
তুমি কি মনে করো আমি নাকে ভাত পুঁজি? তোমার সব জোছুরি আমার কাছে ধরা পড়ে গেছে। তুমি বর্বর। তুমি ইতর। বাটপাড়। আমার সঙ্গে তোমার জাল জুয়াচুরির সম্পর্ক। তলে তলে বহু কিছু করে বেড়াও তুমি আমাকে না জানিয়ে, হোর নিয়ে পড়ে থাকো, আমি সব বুঝি, লম্পটের সংসারে জ্বলে মরছি আমি।
আব্বা দারুণভাবে হাঁপাতে লাগলেন। বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? প্লিজ একটু আস্তে কথা বলো, দোহাই তোমার। এসব কি যা-তা কথা বলছো তুমি, কোথেকে পাও এসব? সম্পূর্ণ মিথ্যে, সম্পূর্ণ মিথ্যে! কী আশ্চর্য, আমার সম্পর্কে এই তোমার ধারণা? পনেরো বছরের বিবাহিত জীবন আমাদের, কি করে বললে এসব, ছি ছি! যা বলার মাথা ঠাণ্ডা করে বলো, আমি সব শুনতে রাজি। আমি যদি কোনো অন্যায় ঘটিয়ে থাকি তার জন্যে জবাবদিহিও আমাকে করতে হবে বৈকি–