তোমার যদি সখ চাগিয়ে থাকে আত্মীয়তার ঢাক পেটানোর, কর্তব্যপালনের ঢোল পেটানোর—তাহলে নিয়ে এসোগে, এসবের ভেতর আমাকে জড়াতে চাও কেন! আমি কি বুঝিনে এসব লোক দেখানো। আমার কোনো মতামত নেই এ ব্যাপারে, নিজে যা ভালো বোঝো তাই করো।
এটা কি কোনো উত্তর হলো?
এর চেয়ে ভালো এর চেয়ে স্পষ্ট উত্তর আমার জানা নেই। খামোকা চটিয়ো না আমাকে।
চটছো তো তুমি নিজেই! শোনো–অনু বুঝতে পারে শেষ দেখতে চায় আব্বা। একটু থেমে খুব শান্ত কণ্ঠে বললেন, ঠাণ্ডা মাথায় একটু চিন্তা করে দেখার চেষ্টা করো। তোমারও তো একটা কর্তব্য আছে। আমরা ছাড়া অন্য কেউ থাকলে সেখানে না হয় একটা কথা ছিলো।
মা বললে, কেন বিধবা হবার পরপরই এখানে এনে তোলার জন্যে তো আর কম কাঠ-খড়-কেরোসিন পোড়াও নি, তখন তো কারো মতের ধার ধারে নি। তখন যখন নিজের দেমাকটাকে অতো বড়ো করে দেখতে পেরেছিলো এখন আবার আসার দরকারটা কি? এসে কি আমাদের একেবারে রাজা করে দেবে তোমার দুলালী বোন?
তুমি ভুল বুঝেছে ওটাকে দেমাক বলী তোমার অন্যায়। তুমি নিজে বুঝতে পারো না, উপায় থাকতে যেচে কেউ কারো গলগ্রহ হতে চায় কখনো, না সেটা উচিত? তখন ওর মনের জোর ছিলো। বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে মানুষমাত্রই এমনধারা ভেঙে পড়ে, দুর্বল হয়ে যায়–
মা বাধা দিয়ে বললে, মনের জোর নয়, বলো রূপের বহর ছিলো, রূপের দেমাক ছিলো, বরং এখানে ওর অসুবিধেই হতো। এখন বোধ হয় ওসবে ভাটা পড়েছে–
আব্বা অপেক্ষাকৃত গম্ভীর হয়ে বললেন, যাকগে ওসব নিয়ে মিছিমিছি তর্ক করে কোন লাভ নেই। তুমি তোমার মতো বুঝে বলছো, আমি আমার মতো বুঝে বলছি। ওর ব্যথাটা যে কোথায় আসলে তুমি আমি কেউ-ই তা বুঝবো না, কেননা আমরা ওর অবস্থায় পড়ি নি–
মা আবার থামিয়ে দিয়ে বললে, বলো আমি বুঝি নি, ব্যথাটা যে কোথায় তুমি ঠিকই বুঝেছিলে, বুঝেছিলে বলেই ছাড়াগরু করে রেখেছিলে, এখনো বুঝছো। এক রসুনের গোড়া তো সব!
তাহলে কি লিখবো বলো? বললাম তো যা বলার—
তোমার তাহলে মত নেই?
আমি কিছুই জানিনে এ ব্যাপারে।
একটা অসহায় মেয়ের জীবনের চাইতে তোমার নিজের জিদটাই তাহলে বড়ো হলো।
অসহায়? অসহায় বলতে তুমি কি বোঝতে চাও? গ্রামের বাড়িতে তো এতোদিন ওনার কোনো অসুবিধেই হয় নি, বেশ তো সুখেই ছিলেন। এতোদিন নিজের মনের মতো করে!
কী আশ্চর্য! এতদিন যা ভালো লেগেছে এখনো তাই ভালো লাগতে হবে এমন কোনো নিয়ম আছে নাকি? এতোদিন গ্রামে পড়ে ছিলো বলে এখনো থাকবে—চিরকালই থাকবে, এটা কোনো যুক্তির কথা? আমাদের কাছে আসতে চায় কেন সেটা একবার ভেবে দেখছো! ও ধরে নিয়েছে আমরা ওকে বোঝা মনে করবো না, আপনজনের মতোই খুশি মনে নিতে পারবো, সেইজন্যেই তো? তুমি কি বলতে চাও এটারও কোনো মূল্য নেই? সবদিক বিবেচনা না করে ঝটাঝট মন্তব্য কোরো না।
আমি তো তা চাই না, এখন তুমি যদি জোর করে আমাকে বলাও আমি কি করবো। আমার কোনো মতামতই কখনো তোমার মনে ধরে নি, সব জানা আছে আমার, ধরবেও না কোনো দিন। আমি তোমার নামে স্ত্রী। যেখানে আমার অমত থাকলেও তুমি তোমার দোলারবিবি প্রাণের বোনকে না এনে পারবে না সেখানে আবার নাটুকেপনা দেখিয়ে এতো জিগ্যেস করাকরির কি আছে!
ধরো তোমার অমত এতে, কিন্তু আমাকে বোঝানোর জন্য তুমি কতোগুলো কারণ দেখাবে না? না তারও কোনো প্রয়োজন নেই?
প্রয়োজন আবার কিসের? আমার সংসারে আমি যদি আগাছা-কুগাছা টেনে আনা ভালো মনে না করি তার জন্যেও কৈফিয়ত দিতে হবে আমাকে, কি আহাদের কথা! সংসার আমার আর যাবতীয় অধিকার তোমার, চাকরানীর চেয়ে বেশি কিছু নই, এই বলতে চাও তো? আমি তোমাকে সাফ সাফ বলে দিচ্ছি, খেয়ালখুশিমতো তুমি যদি নিরন্তর আমার কাঁধে এভাবে জোর খাটানো বোঝা চাপিয়ে দিতে থাকো তাহলে আমি নিজের পথ। নিজে বেছে নেবো। তখন তোমার যা মনে হয় তাই করে বেড়িয়ে, আমি ভুলেও দেখতে যাবো না। নিজের বোনের দিকটাই তোমার কাছে বড়ো, আমাদের দিকটা কিছু নয়। একজন কেপ্টেরও যে অধিকার থাকে তোমার কাছে আমার তা-ও নেই। তুমি শুধু হুকুম করে যাবে আর জীবনভর তাই দাসী-বাদীর মতো মাথা পেতে মেনে যাবো, কি সুখের কথা আমার!
আব্বা নিরুত্তর। এই মুহূর্তে মার মুখের দিকে তাকানোর ক্ষমতা তাঁর নেই, অনু বুঝতে পারে। বুকের উপর মাথা ঝুলে পড়েছে তাঁর। ভেতরের কষ্টকে মানুষ কিভাবে সামলায় অনু সেই কথাই ভাবতে চেষ্টা করে।
অনেকক্ষণ কি কোথায় সব ভাবলেন। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, তুমি যদি সবকিছু এইভাবে বিচার করো তাহলে কোনো কথাই বলা চলে না!
আমি এইভাবেই বিচার করতে শিখেছি।
ওটা তোমার ভুল।
আমার ভুল আমার কাছে ভালো–
ভুল কখনো ভালো হয় না, ভবিষ্যতে না পড়লে বোঝা যায় না!
আবার নীরবতা।
আব্বা কাশলেন একবার।
আমার অনুরোধ রানির দিকটা তুমি ভালোভাবে একটু বিবেচনা করে দেখবে। খেয়ালখুশিমাফিক যা ইচ্ছে তাই কিছু একটা বলে দিলে সেটা সত্যিই অন্যায় হবে।
চোখ বড়ো বড়ো করে তীব্রকণ্ঠে মা বললে, তার মানে জোর খাটিয়ে আমাকে রাজি করাবেই তুমি, তার মানে তোমার হুকুমটাই কুকুরের মতো জিভ দিয়ে চাটতে হবে এই বলতে চাও তো তুমি?
আমার সব কথা বুঝেও ইচ্ছে করে অন্য পথে যাচ্ছো তুমি–অনু লক্ষ্য করলে হঠাৎ হেসে ফেলে ওকথা বললেন আব্বা; বললেন, তোমার বিবেক এতে তোমাকে ক্ষমা করবে তো?