কি যে করা যায়—কাতরতা অঙ্কুরিত হয়। দুপুর আর কাটতেই চায়। কি অবসাদ। কি অসহায়। ঘরের ভেতরে একা একা নিজেকে নিয়তই বন্দী মনে হয়।
ঘুমিয়ে দুপুরবেলা ওড়ানো সম্ভব হলে সমস্যা ছিলো না, কিন্তু ঐ সময় ঘুমোবার কথা ভাবতেও পারে না। খাটের পুরু তোশকে তুলোর গরমে ছাদের শিকারী রৌদ্র ঘাপটি মেরে থাকে। জলেশ্বর মালীর মতো, মালীবৌয়ের মতো খুব ঠাণ্ডা মেঝেয় হাত-পা ছড়িয়ে সটান পড়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ফরাশ পাতা মেঝের উপরেও শোবার উপায় নেই, মা ক্ষেপে উঠবে। অনেক কিছুই তার সহ্য হয় না, ধাতে পোষায় না। বইয়ের রঙিন মলাটে কালি পড়ে গেলে ক্ষেপে ওঠে, নাকে হাত চেপে না হাঁচিলে ক্ষেপে ওঠে, রঙের বাক্স কালি-কলম-দোয়াত এলোমেলো ছড়িয়ে রাখলে ক্ষেপে ওঠে, অনেক কিছুই মার কাছে অসহ্য। বাঞ্ছারামপুরে বেড়াতে গিয়ে গ্রামের ছেলেদের পাল্লায় পড়ে পুকুরে কলমিলতার ফুল তুলতে গিয়েছিলো সে, তাতেও চটে গিয়েছিলো মা; রাগের চোটে বেড়ানো বাতিল করে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ফিরে এসেছিলো ঢাকায়।
এইভাবে দীর্ঘ অসতর্ক মুহূর্তে নিজের অগোচরে তার ভেতরের যাবতীয় বোবা ইচ্ছেগুলো ধীরে ধীরে ফ্রিজের ঠাণ্ডা বোতলের মতো যখন ঘেমে ওঠে, এবং খাঁখাঁ দুপুরের হাঘরে ছেলেদের মতো ধুলোবালি মাখা হাওয়ার গরগরে শরীর জানালা টপকে এইসব ভিজে ইচ্ছের ওপর নাক ঘষে পরক্ষণেই আবার উধাও হয়ে যায়, তখন অকারণেই সমস্ত আকুলতার ভেতরে মাকে পাবার অদম্য আগ্রহ চিলের আর্তনাদের থরে-বিথরে পালকের মতো ভেসে। বেড়ায়।
গুমরে উঠতে থাকে অনু,—মা কোনো এক মরা নদী। ইচ্ছেরা সব জলেশ্বর মালী। ইচ্ছেরা সব এক একটা চন্দনের পুরানো কৌটো।
এই ধরনের কৌটো মার ট্রাঙ্কে আছে। উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে মা। প্রপিতামহদের আমলে তাদের কেউ গোলকুণ্ডার হীরা রাখতো সেটায়। দাদু রাখতো তার অব্যবহৃত একটি পাথরের চোখ। মা রেখেছে বিষ; যতোদূর মনে পড়ে একদিন চুপি চুপি তাই-ই যেন বলেছিলো।
মস্ত এক বাড়ির খোলের ভেতর আমি,—অনুর এক একবার খুব আচ্ছন্নভাবে মনে হয়, বেদম জ্বরের ঘোরে গ্লাস উপুড় করে তৃষ্ণা মেটানোর পর যেমন ভেতরটা হাঁসফাঁস করে, এও তেমন। সব মিলিয়ে আঠারো কি উনিশটা ঘর, পুরোনো আমলের দোতলা, খড়খড়ির বড়। জানালা, মোটা মোটা কড়ি-বরগা, উঁচু ছাদ। এমন উঁচু ছাদ যে মনে হয়। ওর ওপর আর আকাশ নেই।
কোনো উদ্ৰবও নেই। অতিরিক্ত কোনো শব্দ নেই। নিজের পায়ের শব্দ নিজেকেই ভয় দেখায়; গলা দিয়ে বের হতে না পারা একটা বিশ্রী ঢেকুরের মতো এই মস্ত বাড়িটার বুকের কাছে সে আটকে গিয়েছে। কখনো দরবেশ আলি কিংবা অন্য কেউ হামানদিস্তায় কিছু কুটলে বাড়িটা খুশি হয়, দেয়ালের চেহারা থেকে খুশির এই মেজাজ সহজেই আবিষ্কার করতে পারে সে। এক সময় মা তার সব অভাবই পূর্ণ করতো, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই চিন্তাটাই ক্যাকটাসের কাটার মতো তাকে খুঁড়তে থাকে। সোডা ফাউন্টেন, কখনো বইয়ের দোকান, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে কখননা, কখনো ডিজনির ছবি—এক সময় এইসব ছিলো। কখনো যাদুঘরে, কখনো কার্জন হলের বিচিত্রানুষ্ঠানে, মা এক সময় যথেষ্ট সঙ্গ দিয়েছে তাকে। কোথাও যাওয়া না হলে খুব মনোযোগ দিয়ে তার ছবি আঁকা দেখতো, উৎসাহ দিতো কিংবা আগডুম-বাগডুম সব গল্প শোনাতো পুরোনো আমলের; বুড়ো-হাবড়াদের মুখ থেকে শোনা সেসব। তা না হলে দুজনে মিলে এ্যাকোয়ারিয়ামের পানি বদল করা-ধরাবাঁধা এই কাজটা ছিলোই।
এখন ফিল্টার, এয়ার পাম্প, হিটার সবকিছু এসে সেসবের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। মা বলে-ঝক্কি মিটেছে, সাফ করাটা একটা বদখত ঝামেলা। যে-কোনো কাজ একনাগাড়ে করতে গেলেই পানসে হয়ে যায়। তার কোনো মজা থাকে না–
কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু আগের মতো মেথিলিন ব্লুতে মাছগুলোকে নিয়মিত চোবানো হয় না, কি বিশ্রী ঘেয়ো চেহারা এখন মাছগুলোর, এ যেন মরে যাওয়া সব উৎসাহের এক মর্মান্তিক রূপ। সোর্ডটেল আর ব্ল্যাকলি বাচ্চা পাড়ছে আর গপাগপ গিলছে, এ্যাঞ্জেল ফিশ মরে যাচ্ছে একের পর
এক। সবকিছু ফেলে মা-ই একসময় ফাইটারের ডিম দেওয়া দেখতে ভালোবাসতো একনাগাড়ে সারাদিন ঠায় বসে। ঝক্কি চুকেছে, এখন সেসবের কোনো বালাই নেই।
সবচেয়ে আগ্রহী ছিলো মার মুখ থেকে গল্প শুনতে। শৈশবে কোনো এক সময় দার্জিলিং-এ ছিলো, সেইসব ইতিবৃত্ত এবং আব্বার প্রসঙ্গ।
আব্বার প্রসঙ্গই সাধারণত বেশি থাকতো।
অনু আব্বাকে সহ্য করতে পারে না। শয়তান মনে করে। ঘৃণা করে। যে সময় তিনি ঘরে থাকেন সে ইচ্ছে করে গা বাঁচিয়ে সন্তর্পণে বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে নিজেকে আড়াল করে রাখে। প্রথমে ছিলো ভয়। এখন ভয় থেকে ঘৃণা। ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত, কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যরশ্মি, কমলালেবু আলুবোখারা আর স্কোয়শ ফলের গল্প তার মনে যে আনন্দলোক নির্মাণ করতো তা আবার হারিয়ে যেতো আব্বার প্রসঙ্গ উঠলে। প্রতিনিয়ত মনে হয়েছে মায়ের গলায় কানে দার্জিলিং-এর গোল্ডস্টোনের যে দুল আর পেনডেন্ট দিনরাত ঝকমক ঝকমক জ্বলে তার অন্তরালে আত্মগোপন করে আছে বিধাতার মতো গম্ভীর নিষ্ঠুর হিংসাপরায়ণ কোনো আব্বার রাক্ষুসে অন্ধকার, যার কোনো প্রকাশ নেই, চাকচিক্য নেই, ভয়ঙ্কর গোপন জঘন্য কোপন তার স্বভাব। আর কোনো ভুবন নেই মা ছাড়া। আব্বাকে এড়িয়ে, পাতার আড়ালে পাখির মতো নিজেকে ঢেকে রেখে সে তার আলোর ভুবনে এইভাবে পরিত্রাণ পেতে চায়।