আব্বাকে দেখে মনে হলো অনুর এতোগুলো কথা বলার পর নিজের কাছে কিছুটা চমকৃত বোধ করছেন এখন। তাঁর চোখে-মুখে এক ধরনের লালচে রঙ ধরে গিয়েছে। মনে হলো পরম পরিতৃপ্ত : নিজের বদ্ধমূল ধারণা অতি সহজেই চালান দিতে পেরেছেন, বিশ্বাসের উপযোগী করে তুলে ধরতে পেরেছেন, এই তার আনন্দ। যাচাই করে দেখার কোনো অভিপ্রায়ই তাঁর নেই, বিতর্কে অনিচ্ছুক, সহজে পরিতৃপ্ত হওয়াটাই যেন চিরাচরিত অভ্যেস।
সহ্য করতে পারছিলো না মা।
মার মুখ কঠিন। বিরক্তি আর অসহনীয়তার আবর্তে পড়ে মাঝে মাঝে দমকা নিশ্বাস ছাড়ছিলো মা।
কথা শেষ হতে বললে, এমনভাবে কথা বলছো তুমি যেন অনু একটা খুনের আসামি, অভ্যেস খারাপ হয়ে গিয়েছে তোমার, ঘর-বার সব এক তোমার কাছে!
মার মুখে এমন ধারালো দৃঢ়তার চিহ্ন দেখতে পেল অনু যে চোখ সরিয়ে নিতে হলো তাকে। এই দৃঢ়তার ফলে কি দুর্বিষহ কাঠিন্যেই না ছায়াচ্ছন্ন মার মুখ। ভেতরের চাপা অস্থিরতা বেপরোয়াভাবে উপর্যুপরি চলকে উঠছিলো সেই চেহারায়; অসন্তুষ্টি কি ভীষণ বদলে দেয় মানুষকে।
বাণীখালারা উঠলো এক সময়। যাওয়ার সময় বাণীখালা বললে, যাওয়া ছেড়ে দিলেন কেন আমাদের ওদিকে?
সময় করে উঠতে পারিনে আজকাল।
মা বললে, আমার সঙ্গেই দেখা করার ফুরসত নেই ওনার, আবার তোমাদের ওখানে যাবে।
বাণীখালা হেসে বললে, সবাইকে নিয়ে যাবেন কিন্তু। আমি বারবার এসে ঘুরে যাবো আর আপনারা যে যার গোঁ বজায় রেখে মাড়ি চেপে বসে থাকবেন সেটি আর হচ্ছে না। আপনারা না গেলে আমি আর এ পথ মাড়াচ্ছিনে, বলে রাখছি আশেই।
আব্বা মাথা নিচু করে হাসতে লাগলেন, সবকিছু লক্ষ্য করে অনু।
মা বললে, আমাকে নিয়ে বের হবেন উনি? তুমি বলছো কি, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে বুবু? আমাকে নিয়ে বের হলে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে না ওঁর। আমাদের মতো চাকরানীদের সঙ্গে নিয়ে কি আর বাইরে যাওয়া যায়।
বাণীখালা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে হেসে ফেললে সেটা ঢাকার জন্যেই। বললে, অতশত বুঝিনে বাপু, মোট কথা তোমরা না গেলে আমি আর আসছিনে।
ওরা চলে গেল এরপর। গোর্কিরা শাসিয়ে গেল যথারীতি, আগামীবারের জন্যে অনু যেন প্রস্তুত থাকে, পরাজয়ের যোগ্য উপহারই নিয়ে আসবে তারা।
কিন্তু এসব বিন্দুমাত্র দাগ কাটে না তার মনে; এসব নিয়ে অনুর অতো মাথাব্যথা নেই। আব্বাকে আজ তার কেন যেন অন্যরকম মনে হলো। কি নিষ্প্রভ! কি নিস্তেজ! বিকেলবেলার নুয়ে পড়া নিরুপদ্রব শান্ত আলো মনের কোণে উঁকি দেয়; কতো বুড়ো হয়ে গিয়েছেন। দারুণ ইচ্ছে হয় অনুর সারারাত গল্প শোনার। হঠাৎ ইচ্ছে করে প্রাণভরে ভালোবাসতে। অনুর মনে হয় পৃথিবীর সব বুড়ো মানুষের চেহারা ছবিতে দেখা আইনস্টাইনের মতো হয় না কেন!
বিদায় দিয়ে মা ফিরে এলো।
আব্বা বসেছিলেন আগের মতোই, যথাযথ। মাকে উদ্দেশ করে বললেন, বোসো, আজ কিছু বৈষয়িক আলাপ আছে তোমার সঙ্গে।
বাইরের গুমোট আবহাওয়া আরো ঘনীভূত হয়েছে এখন। সারা শহরের বুকে এক অনড় জগদ্দল বসিয়ে দিয়েছে কেউ। জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখলো অনু। গাছপালা বাড়িঘর সবকিছু থমকে আছে। ঘরের ভেতর নির্বিকার শিলিং ফ্যান ঘুরছে, ভ্যাপসা গরম কোনো রকমেই আর কাটতে চায় না। ভেতরে ভেতরে হাঁপিয়ে উঠে সে। হাঁসফাঁস করতে থাকে। কোনো কিছুতেই স্বস্তি নেই। ধীরে ধীরে দানা বেঁধে উঠছে প্রাণান্তকর অশান্তি। সে গন্ধ পায়, উকট সে গন্ধ; দুর্বিষহ। তার ভেতর থেকে কেউ কানে কানে ফিশফিশ করে বলে দেয়—পালাও অনু, এখানে থেকো না, পালাও, এখানে তুমি মরে যাবে, এরা তোমাকে মেরে ফেলবে, অনু তুমি পালাও!
নীরবতা ভঙ্গ করে আব্বা এক সময় বললেন, রানিকে আমি আমাদের এখানে আনতে চাই!
রানি—অর্থাৎ বাঞ্ছারামপুরের ফুফুর কথা বলছেন।
মা নিরুত্তর।
মার ইচ্ছাকৃত ঔদাসীন্যে টোকা দিয়ে আব্বা আবার বললেন, ও আর গ্রামে পড়ে থাকতে চায় না। ওকেই বা কি দোষ দেবো, আর কতোকাল বেচারি একা একা গ্রামে পচে মরবে।
মা আগের মতোই মুখ নিচু করে বসে রইলো। মার এতে সায় নেই, বুঝতে পারে অনু। মাকে সে ভালো করেই জানে।
তুমি কি বলো। আমার মনে হয় আমাদের কাছে রাখাটাই উচিত কাজ হবে। আমাদেরও তো একটা কর্তব্য আছে, বিশেষ করে আমি ওর বড় ভাই যখন। কর্তব্য তো কিছুই করতে পারলাম না কোনোদিন।
মা বললে, কর্তব্য পালন করো না কেন? কে তোমায় বাদ সেধেছে? নাকি দড়ি দিয়ে হাতপা বেঁধে রেখেছে কেউ?
কথাটা তা নয়, আব্বা নড়েচড়ে বসে বললেন, ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনোদিনই কিছু করতে চাই নি। এতোদিন অনিচ্ছুক ছিলো, এখন মন বদলেছে, এখানে আসতে চায় বলে লিখেছে, এই জন্যেই কথাটা তুললাম।
তোমার পেয়ারের বোন, তুমি যা ভালো বুঝবে তাই করবে, এতে আবার আমাকে নিয়ে টানা-হাচড়া কেন। অন্যদের বেলায় তোমার কখনো কোনো অভাব নেই, যতো অভাব আমার বেলায়। ওসব কথা আমাকে জিগ্যেস করে কি লাভ এমন!
তোমাদের সঙ্গেই যখন থাকতে হবে তাকে, তখন তোমাদের মতামতের প্রয়োজন আছে বৈ কি!
আমার মতামতের তুমি ধার ধারো?
ঠিক বুঝে উঠলুম না কথাটা!
বুঝেও যদি না বোঝার ভান করো।
ভান? ভান আবার কোথায় দেখলে? পরিষ্কার করে বলো যা বলতে চাও। আমি তো আর জোর করে তোমাদের ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছিনে। সেই জন্যেই তো তোমার মতামত জানতে চাইলুম। তুমি গররাজি হলে আসতে বারণ করে দেবো, সোজা কথা, এর ভেতরে আবার ভান দেখলে কোথায়!