বাণীখালা বললে, অন্য কোনো কারণও তো থাকতে পারে?
তদন্তের যে রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে তা থেকেই সব পরিষ্কার ধরা পড়েছে–অনু দেখলো আরামে গা ঢেলে উত্তরোত্তর উৎসাহিত হয়ে পড়ছেন আব্বা—ভদ্রলোক ডায়েরিও মেনটেন করতেন, সেখানা আমি নিয়ে এসেছি ভালোমতো স্টাডি করবো বলে। খুবই ইন্টারেস্টিং। দুএকটা পাতা পড়ে শোনাচ্ছি। আমি আন্ডারলাইন করেছি বিশেষ কতোগুলো জায়গায়, মনোযোগ দিয়ে শুনুন,—তিনি পুনর্বার দেখা দিলেন, কহিলেন, আর কতোকাল দরবারী ভৈরবী মল্লার লইয়া পচিয়া মরিবে, উহাতে আর বিন্দুমাত্র রস অবশিষ্ট নাই, তোমার পূর্বে বহু শতাব্দীব্যাপি নানাজাতের হাহাপুঙ্গব উহার যাবতীয় রস নিংড়াইয়া লইয়াছে,—খেয়াল করে যান ভালো করে। অন্য এক জায়গায় লিখেছেন—ওরে মূখ, রাগাবলীর নিবিড় অলংকরণে অদ্যাবধিও গমকের আশ্রয়ে মিথ্যা সুরের জলাঞ্জলি দিয়া অযথা নিঃশেষিত-প্রায় তুই, অলঙ্কার উহার দুষ্টক্ষত বিশেষ, দেখিতেছ না অলঙ্কারের ভারে লম্পটের রক্ষিতার ন্যায় রাগাবলীর প্রাণ কী ওষ্ঠাগত। যাহারা শক্তিমান, সৃষ্টির নৈপুণ্যে অতুল, তাহারাই কেবল দেহ-মন-প্রাণ দিয়া শিল্পের নবজন্ম যাজ্ঞা করে, তাহাদের ধর্ম তাহাদের কর্ম তাহাদের বর্ম গতানুগতিক প্রবহমানতার ঋজু বলিষ্ঠ বিরুদ্ধাচরণ, অতঃপর তিনি হাপুস নয়নে ক্রন্দন করিতে লাগিলেন, এই দৃশ্য অবলোকন করত আমিও শোকে ভূলুণ্ঠিতা বাল-বিধবার ন্যায় নিদারুণ মর্মভেদী বিলাপে সাতিশয় মগ্নতাপ্রাপ্ত হইলাম। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না নিশ্চয়ই, তারপর আরো লিখেছেন,—তাঁহার রাগান্ধ রক্তচক্ষুর সম্মুখে আমি বিশুষ্ক তৃণবৎ ভষ্ম হইয়া গেলাম, তিনি সবেগে পদাঘাত করিয়া কহিলেন, নরাধম, তোর গতি নাই, তোর বিকাশ নাই, তোর ব্যাবৃত্তি নাই, অনুগম নাই, আমি চলিলাম, পুনর্বার দর্শনের সৌভাগ্য হইতে রে হতভাগ্য তোকে বঞ্চিত করিলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই তিনি আর কিছুই নয়, সেই ষোলকলার পূর্ণ বাটির যন্ত্রণা। একটু ভালো করে খতিয়ে দেখলেই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে যায়। এই সবেমাত্র আমরা কালার মিউজিকের যুগে পা দিয়েছি, অথচ প্রায় তেইশশো বছর আগে এর সম্ভাবনার কথা বলে গিয়েছেন অ্যারিস্টটল। কই এই তেইশশো বছরের মধ্যে এ ব্যাপারে অত্যুৎসাহী কোনো সঙ্গীত সাধক তো ব্যর্থতার গ্লানি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে নি। আসলে প্রবৃত্তির প্রবল তাড়নায় ভদ্রলোকের বাহ্যজ্ঞান ভেদজ্ঞান সবই সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছিলো। অর্থাৎ এক ধরনের লোভের তাড়নায় তিনি মাত্রাজ্ঞান পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে ফেলেছিলেন। সস্তা হাততালির লোভ নয় ঠিক, বিখ্যাত হবার লোভ। চেয়েছিলেন নতুন কোনো দরোজা উন্মুক্ত করে সঙ্গীতের জগতে কোনো একটা বিপ্লব ঘটাতে। ভদ্রলোকের জন্যে সত্যিই করুণা হয়। বেচারার এগো নির্বিরম বাসনার দোর্দণ্ড প্রতাপে মার খাচ্ছিলো, পথ করে নিতে পারছিলো না নিজের; অথচ দ্বন্দ্বসঙ্কুল এই পৃথিবীতে বাস করতে হলে যতো ব্যথাই সে পাক না কেন যতো কষ্টই সে পাক না কেন নিজের অস্তিত্বের জন্যে সন্তোষজনক একটা রাস্তা তাকে খুঁজে নিতেই হবে। পৃথিবীর আলো-অন্ধকার, দুঃখ-আনন্দ, জরামৃত্যু, শোক, সবকিছুর মাঝখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে এইভাবেই এগিয়ে আসে সুপার এগো। এইভাবে পরিত্রাণ মেলে মানুষের। কিন্তু ঐ ভদ্রলোকের ভাগ্যে তা আর ঘটে নি, আসলেই ভয়ঙ্কর রকম চরমপন্থী। নির্বিকার বুদ্ধিই হলো চৈতন্য আর সবিষয় চৈতন্যই হলো বুদ্ধি; কিন্তু ভদ্রলোক চৈতন্য ও বুদ্ধির কোনো প্রভেদই ধরতে পারেন নি, গুলিয়ে ফেলেছিলেন সব। শেষের দিকে প্রায় উন্মাদই হয়ে গিয়েছিলেন, বেচারা। মানুষের মাথার খুলি দিয়ে নতুন ধরনের বীণা আবিষ্কারের মতলবে গা ঢাকা দিয়ে কবরের মাটি আলগা করতে গিয়ে ধরা পড়ে নাস্তানাবুদ হলেন, আরো কত কি! কখনো জোড়া পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতেন, কখনো গড়াতে গড়াতে এসে রাস্তায় গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতেন, এইসব যা-তা ব্যাপার। আসলে নতুন একটা কিছু সৃষ্টির বাসনা শেষ পর্যন্ত উন্মাদনায় গিয়ে পৌঁছেছিলো আর এর পেছনে ওত পেতে ছিলো নিদারুণ লোভ, তাই ব্যাপারটা এতোদূর গড়াতে পেরেছিলো। কেঁদে ভাসিয়ে দিলেও সেই অভিশপ্ত আর্তিকে গোর দেওয়া সম্ভব নয়। পূর্ণ বাটির এই যন্ত্রণাকেই আমরা খুব সীমিত অর্থে কখনো কখনো যুগ-যন্ত্রণা বলেও সহজে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করি। যার ভেতর কিছু না কিছু চৈতন্যের স্ফুরণ ঘটেছে, এই সর্বনাশা যন্ত্রণা থেকে কিছুতেই তার অব্যাহতি নেই। জানেন, অনেক সময় ক্রিমিনালদেরও তাই ঘৃণা করার কোনো উপায় থাকে না, ফিরিয়ে দেবার কোনো উপায় থাকে না। তার আগে সেই স্বার্থপর সুন্দর বাটিটাকে চুরমার করে দিতে হয়–
রাখো তোমার বাটি। ঘরের ভেতর ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সামনে ঐসব উদ্ভট গল্পগুলো না জুড়লেই বোধ হয় নয়? তোমার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। অনুর মুখ কালো হয়ে গিয়েছে সে খেয়াল করেছো একবার? বিরক্তিতে ফেটে পড়ে মা বললে ওকথা।
তুমি অকারণে এগুলোকে উদ্ভট বলে উড়িয়ে দিচ্ছো কেন? ধরো অনুর কথাই। ও এখনো ছোটো। নিজের কোনো সত্তাই এখনো তৈরি হয় নি। আমাদের ছায়ায় ছায়ায়, আমাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে ও। কিন্তু এরপর বয়েসের এমন একটা দুঃসময় আছে সেখানে পা রাখা মাত্রই নিজের সঙ্গে সাক্ষ্মতিক রকমের বিরোধের সম্মুখীন হতে হবে ওকে। তখন পুরোনো সব অভ্যেস প্রলয়ঙ্করী ঝড় আর জলোচ্ছাসে খড়কুটোর মতো কোথায় যে ভেসে যাবে নিজেও আন্দাজ করতে পারবে না। এমন বয়েস একসময় আমাদেরও ছিলো। দুপুরগুলো ঐ বয়ে: আমার কাছে ঝিনুকের ঝরঝরে ঝরনা মনে হতো, ভাল লাগতো। এক পদ্য লিখিয়ে বন্ধু ছিলো, সে বলতো জল্লাদের জঠরাগ্নি। আমি ওকালতি করছি, আর সে বেচারা মশক নিয়ন্ত্রণের তদারকি করতে করতে সেই জঠরাগ্নিতে প্রায় পরিপাক হয়ে গিয়েছে। নিজের ভেতরে একটা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে নিতে হয়, তার জন্যে চাই সুস্থ প্রতিজ্ঞা, সুনির্দিষ্ট প্রতীক্ষা। অনুর সেই প্রতীক্ষার দিনগুলো যেন নিঃসঙ্গ না হয় সেদিকেই কেবল খেয়াল রাখতে হবে আমাদের।