জটিল আচ্ছন্নতায় ক্রমাগত কুণ্ডলি পাকাতে থাকে অনু। অগোচরে, বুঝিবা সম্পূর্ণ নিজের মতো এমন এক নিরাকার হিরন্ময় জগৎ নির্মাণ করতে চায় সে, যেখানে নাম না জানা গোত্রহীন তুচ্ছ কষ্টের আবেদনগুলোও অতি সহজে অঙ্কুরিত হতে পারে।
নিজেকে কিছুতেই সনাক্ত করতে পারে না অনু। কখনো চৈতন্যের প্রখর এক রশ্মি চাবুকের মতো কশাঘাত করে আবার মিলিয়ে যায়। কখনো হেঁয়ালির অন্তর্লোকে দুর্বল অসহায়ের মতো মুঠো পাকাতে থাকে। হাঁসফাঁস হাপরের মতো দিনগুলোর কাছে জমে উঠেছে অপরিসীম ঋণের পাহাড়, স্বরাচ্ছন্নের মতো এইসব মনে হয় অনুর। এই হাঁসফাঁস হাপর থেকে, হানাদার হওয়া থেকে, কালবৈশাখীর কামদ উল্লাস থেকে, কিংবা রক্তাক্ত রত্নাভরণের মতো সন্ধ্যারাত্রি থেকে, বধ্যভূমির হাহাকার ছিনিয়ে নিয়ে তার আপন জগতের সভ্যতাকে নিরন্তর এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় সে; যেন ধরে নিয়েছে বিশাল পৃথিবীর মাঝখানে ঘরজোড়া ঘেরাটোপের নিচে আত্মগোপনের অর্থই হলো টুটি টিপে অন্ধ বধির ঘাতকের মতো নিজেকে হত্যা করা।
বাণীখালা সাধারণত খুব কম আসে, কিন্তু হঠাৎ যেদিন এসে পড়ে সেদিন মনে হয় ফিরে যাবার অভিপ্রায়ে আসে নি।
সে নিচে গিয়ে দেখা করলো।
বাণীখালা মার সঙ্গে কাঠমুন্ডু যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে আলাপ করছিলো। বললে, যাসনে কেন, দিন দিন আমাদের কথা ভুলে যাচ্ছিস, বস এখানে!
তারপর পুনরায় সেই কাঠমুন্ডুর প্রসঙ্গ।
আমি ভাবতেও পারি নি ওরা আমাকে এভাবে ঠকাবে। যে স্মোকি টোপাজ দুশো টাকা নিয়েছে এখানেই তার দাম ষাট-সত্তর টাকা। সবচেয়ে বড় ঘাই মেরেছে তোর সোনার চাঁদ দুলাভাইকে। আমি হাজারবার পৈপৈ করে বারণ করলাম, উনি কানে তুললেন না। বেশি চালাক কিনা, বললেন। দুশো টাকায় ক্যাটসআই পাওয়া যাচ্ছে, হাতছাড়া করাটা নিছক বোকামি। এখন বোঝে, যাবে না টাকাটা গচ্চা। ঢাকায় ফিরে যে কটা জহুরিকে দেখানো হলো সবাই বললে পনেরো থেকে বিশ টাকা দামের মুনস্টোন। লাভ করতে গিয়ে মধ্যে থেকে হড়হড় করে এককাড়ি টাকা বেরিয়ে গেল। বেফায়দা!
অনু মার মুখের দিকে তাকালো। মা হাসছে।
বাণীখালা চটে গিয়ে বললে, বিশ্বাস হলো না বুঝি?
অবিশ্বাসের কি আছে এতে–মা পরিষ্কার গলায় বললে, হাসছি এই জন্যেই যে উচিত শিক্ষাই হয়েছে বেশি লোভ করতে গিয়ে!
তা আর বলতে! দুদিনে ঘুমোতে পারি নি আমি তা জানিস? আমার ননদ ব্যাঙ্কক থেকে প্যাগোডার চূড়ামার্কা প্রিন্সেস রিং আর হ-য-ব-র-ল কি কোথায় সব আনার পর থেকে দেমাকে ফেটে পড়ছে সবসময়, পা পড়ছে আর মাটিতে। ভাবলাম সবাই তো কাঠমুন্ডু গেলে কিছু না কিছু নিয়ে আসে, আমাদের ভাগ্য যে এরকম ফুটো হবে আগে কি আর তা বুঝতে পেরেছিলাম। ঠকেছি ভালোমতোই। তোকে বলতে তো আর কোনো লজ্জা নেই, চারশো টাকা দিয়ে রুবিও এনেছিলাম, শুনলে অবাক হবি ওটাও যাচ্ছেতাই নকল, একেবারে ঠগের মুল্লুক!
মা হেসে বললে, তুমিতো এখানেও কম ঠকো না। ওটা তোমার ধাত। কেন এতোদিন ধরে এই যে বেদেনীদের কাছ থেকে সস্তায় কাঁড়ি কাঁড়ি পিংকপার্ল কিনলে কি কাজে লাগাতে পেরেছো শুনি, নিছক পয়সা নষ্ট না?
তা যা বলেছিস, শুধু লোকসানই দিয়ে আসছি! সখের খেসারত। এবারে কি ভেবেছি জানিস? ওসব হিজিবিজি সখ বাদ দিয়ে বড় দেখে ডায়মন্ড কিনবো, ব্যাস্! এই নাক কান মলা, অন্য কিছুতে আর যাচ্ছিনে বাপু, ঢের সখ মিটেছে, আর নয়!
নিজেকে অপাঙক্তেয় মনে হলো অনুর। সে উপরের ঘরে চলে এলো কিছুক্ষণ পর।
ট্যামবল বললে, আমার এক ফ্রেন্ডের বাড়িতে যে এ্যাঞ্জেল আছে না সেটা দেখলে তুই তোর এই ঘাঁটিগাঁইয়া ছান্দা মাছের মতো এ্যাঞ্জেলকে ছুঁড়ে ফেলে দিবি, সেটা কুইন এ্যাঞ্জেল। তোর সব মাছই কমন। আমার আর এক ফ্রেন্ডের বাড়িতে টেট্রার যে ভ্যারাইটি আছে, ম্যাড হয়ে যাবি দেখলে!
অনু জানালার ধারে দাঁড়ালো।
কি গুমোট আকাশ! প্রচণ্ড গরম। দুদিন ধরে রেডিওতে একনাগাড়ে চিৎকার শোনা যাচ্ছে কক্সবাজার থেকে সাড়ে আটশো মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে; এখন বিপদ সঙ্কেত জানাচ্ছে ঘনঘন। ক্রমশ সরে আসছে ঝড়। হাঁপিয়ে উঠলো অনু।
আব্বা ঘরে ফিরলেন এক সময়।
টেলিভিশন শেষ হলো।
সবাই একজোট হয়ে আসর জমালো অনুর ঘরে। অনু নিতান্ত অসহায়ের মতো বসে রইলো একপাশে। তার মনে হলো মিথ্যা চক্রান্ত করে অকারণে জবাবদিহির জন্যে তাকে এ ঘরে ধরে রাখা হয়েছে।
বাণীখানা আব্বাকে উদ্দেশ করে সাগ্রহে বললে, নতুন কিছু শোনান, বহুদিন পর লেজ ধরা গেছে আজ, কখন থেকে আপনার জন্যে বসে আছি–
আব্বা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে তাঁর সেই ধরাবাঁধা গতে শুরু করলেন, যা দিনকাল পড়েছে, ভাবাও যায় না, মনে হয় আমি নিজেও একজন ক্রিমিন্যাল। আসল কথা এই অতি অগ্রসরমান মানুষের কাছে সবকিছু এমন গতানুগতিক এমন শাদামাঠা মনে হচ্ছে যে নতুনত্বের খাতিরে অভিনবত্বের প্রয়োজনে কোনো একটা কিছু না করা অবধি সে তার মনের মুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। নিত্যনতুন ক্রাইমের পেছনে স্বতন্ত্রভাবে মানুষের এই মোটিভ কমবেশি কাজ করছে। এর একটা কারণও আছে, সভ্যতার বিবর্তনের সাথে তাল রেখেই আমাদের ভেতরের সেই অতি পুরোনো পাথুরে বাটিটার আকারও অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে। আজ সে আরো বেশি পেতে চায় নিজের মধ্যে, কেননা খোলের ভেতর ধরে রাখবার পরিসরও তার বেড়ে গিয়েছে। আসলে সবকিছুই অতি অগ্রসরমান সভ্যতার সেই ষোলকলায় পূর্ণ বাটির যন্ত্রণা। আমার প্রতিবেশী জেড আহম্মদ সাহেবের শ্যালকের কথাই ধরা যাক না কেন। বেশ কিছুদিন হলো বন্দুকের গুলিতে সুসাইড করেছেন ভদ্রলোক। মোটিভ কি, না ব্যর্থতা! বেচারার ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছিলো তিনি। নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন, ব্যাস্। অথচ গাইয়ে হিশেবে যথেষ্ট খ্যাতি ছিলো ভদ্রলোকের। সবসময় লাহোর-করাচি করে বেড়াতেন। পিপলস চায়নায় গেছেন ডেলিগেশনে, রাশ্যায় গেছেন, কি কোথায় সব বিসর্গ চন্দ্রবিন্দু খেতাবও পেয়েছিলেন। পরে জানা গেল সেখানেও ওই একই ব্যাপার। ঐ যে বললাম, যোলকলায় পূর্ণ বাটির যন্ত্রণা।