টপটপ করে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো টোকানির চোখ দিয়ে। ঘা খাওয়া গরুর মতো বড় বড় ভিজে চোখজোড়া অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো সে।
দুপুর সরে গিয়ে সেই কখন বিকেল নেমেছে।
এখন কোথায় যাবে!
কোথাও কেউ নেই।
সারা পৃথিবীর মানুষ দরোজা বন্ধ করে এখন ইংরেজি শিখতে গিয়েছে।
তাদের চাকরি চাই।
পালাতে হলে চাকরি চাই।
গেন্দু, মিয়াচাঁন, ফালানি, নেই এরাও। যখন খেলার পাট উঠে যায়, ওরা এক একজন একে অপরকে আড়াল করে ঝোপ-ঝাড়ের নিচে মাটিতে কোথাও ঘুঘুতে ডিম পেড়েছে কিনা তাই ছুঁড়তে বের হয়, কখনো মোহরের ঘড়া পাওয়া যাবে এই আশায়। নিচে মোহরের ঘড়া না থাকলে ঘুঘু কখনো মাটিতে ডিম পাড়ে না ওরা তা জানে; তলে তলে ভাগ্যকে বদলাতে সকলেই উদগ্রীব।
ক্লান্ত হয়ে পড়লো অনু এক সময়। ভালো লাগলো না আর। কি বিস্বাদ সবকিছু, কি তেতো, বিষাদময়; সব আনন্দ সুতোকাটা ঘুড়ির মতো টাল খেয়ে খেয়ে হাওয়ার উজানে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
ফিরতে ফিরতে সেই একটি বোধই আগের মতো তার মাথার ভেতরে খোলানো শুরু করলো; পৃথিবীতে কোনো কষ্টের বিনিময়েই সরুদাসীকে পাওয়া যায় না। সরুদাসী লামাদের কিংবা তাদের সাজানো বাগানের কোনো ফুলের গর্ভকেশরে মিশে নেই; আপন স্বভাবেরই এক স্বপ্নকমল, যত্নের, কৌতূহলের, সুখ অথবা দুঃখের কোনো কিছুরই অপেক্ষা রাখে না সে; রাত্রি যেমন রজনীগন্ধার, ঠিক তেমনি প্রশান্ত দিবালোকে ফুল হয়ে ফুটে থাকে সরুদাসী, যার স্তবকে স্তবকে স্নিগ্ধ করুণা, যার গর্ভকেশরে অণু পরমাণু হয়ে মিশে থাকে উদ্ভ্রান্ত পাখির সকরুণ গান।
অনুর মনে হয় স্বপ্নের ভেতর থেকে পরিশ্রান্ত পাখির ঝরা পালক উড়ছে আকাশময়।
বিশ্বব্যাপী অপার নিস্তব্ধতা।
কি দুঃখিত কি নিগৃঢ় এই সন্ধ্যা।
বাড়িতে ফিরে এই প্রথমবারের মতো অনু মার সামনে পড়লো।
কোন্ চুলোয় যাওয়া হয়েছিলো?
বাইরে—
বাইরে কেন?
সাপ খেলা দেখতে গিয়েছিলুম! ইচ্ছে করেই মিথ্যে বললো সে।
বেশ বেশ, ঐসব করেই বেড়াও। দেখতে না দেখতে বেশ লম্বা হয়ে যাচ্ছে তোমার পা।
একটু পরে আবার বললে, মন্টু মঞ্জু সবাই তোর জন্যে সেই কখন থেকে হা-পিত্যেশ করে বসে আছে, ঘরে গিয়ে দেখগে যা!
মন্টু মঞ্জু গোর্কি ট্যামবল খুব ঘটা করে শোরগোল বাধিয়ে শ্যাডোজএর রেকর্ড বাজাচ্ছিল। অনুকে দেখে সবাই একযোগে হৈহৈ করে উঠলো। গোর্কি বললে, হাই, কোথায় ছিলি এতোক্ষণ, সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি আমরা।
অনু একথার কোনো জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করলো না, কেবল বাণীখালার কথা জিগ্যেস করলো।
মঞ্জু বললে, মা তো নিচের ঘরে বসে, কখন টিভি শুরু হবে সেই অপেক্ষায় সময় গুনছেন। আজ নাকি ওরা র্যাডিশের আচার শেখাবে।
মন্টু সখেদে বললে, ড্যামিট, ইশ, কি পুওর কালেকশন রে বাবা, একটাও যদি পপটপ থাকে!
অনু বললে, সঙ্গে আনলেই পারতিস!
ভপ্! খুব বড় বড় কথা আওড়ানো হচ্ছে।
অনু বললে, বাব্লগাম!
ইউশাটাপ! মঞ্জু পটাপট জিগ্যেস করা ধরলো, ভিবজিওর সায়েনারার মানে কি, সিন কোনারি কে, বিটলদের চারজনের কার কি নাম, ইত্যাদি।
অনু সবগুলোর জবাব দিয়ে বললে, প্লাটার্স দলের কার কি নাম, হিরোশিমায় পড়া এ্যাটম বমের ওজন কতো ছিলো, এখন বল দেখি!
গোর্কি আর ট্যামবল মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। মন্টু হাঁ হয়ে গভীর আগ্রহে গোল্ডফিশ আর ব্ল্যাকমলির খেলা দেখতে শুরু করলো। একটু পরে বললে, লুক এ্যাট হিয়ার, গাপ্পিটাকে দ্যাখ, কি মিষ্টি!
ট্যামবল বললে, কিউট!
বুঝলাম–অনু বললে, ঠিক আছে স্টাইন দিয়ে দুটো নাম বল।
মঞ্জু বললে, এগুলো কোনো প্রশ্ন হলো—ট্রাশ।
ট্যামবল ঢোক গিলে অতিকষ্টে বললে, আইনস্টাইন, আর একটা যেন কি–
মঞ্জু নিচের ঠোঁট কামড়ে বললে, পেটে আসছে তো মুখে আসছে না—
অনু বললে, আসবে কি করে, বিদ্যেয় জাম হয়ে আছে যে চ্যানেলটা!
নিজে বলো দিকি ম্যান! ট্যামবল অবিশ্বাসের সুরে বললে।
আইনস্টাইন আইজেনস্টাইন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, আরো কতো শুনতে চাস, বাবলগাম বাবলগাম বাবলগাম।
গোর্কি বললে, অলরাইট অলরাইট ম্যান, কতো ধানে কতো চাল নেকস্টটাইম বুঝিয়ে দেওয়া যাবে, এই মাসেই আমরা এগেন হামলা করবো, উড়িয়ে দেবো না তখন।
অনু বললে, পচামার্কা টিভি দেখতে দেখতে তোদের টিবি হয়ে গিয়েছে, এখনো সময় আছে, চিকিৎসা করা। স্রেফ লুসি ডেঞ্জারম্যান আর ফিউজিটিভ দেখে কি আর বুদ্ধি পাকে?
মঞ্জু বললে, তুমি না একেবারে আঁটি পর্যন্ত পেকে গেছ, টুপ করে খসে পড়াটা শুধু বাকি তোমার—ফ্যাগোট!
ঐ পর্যন্তই। বাদানুবাদ আর বেশিদূর গড়ালো না। বুঝতে পারে তার নিজের কাছে এদের আর কোনো আকর্ষণই নেই, ভেতরে ভেতরে কি তীব্র বিরাগই না তার জন্মে গিয়েছে। কোনোমতেই সে সহ্য করতে পারছিলো না ট্যামবলদের। শুধুমাত্র ইস্ত্রিকরা দামি কাপড়ের মড়মড়ে ভাঁজ অতিকষ্টে বজায় রাখার জন্যেই ওরা এই পৃথিবীতে এসেছে। অন্যকে ঠকানো বোকা বানানো কিংবা চমকে দেওয়াটাই ওদের আনন্দ লুটবার একমাত্র রাস্তা; বিকল্প কোনো রাস্তা ওদের কল্পনারও বাইরে। যখন যতোটুকু খিদে থাকে স্বস্তি পায়, ঠিক ততোটুকুতেই যারা তুষ্ট সে তাদের ভালোবাসে—কথাটা আজই এই প্রথম তার মনে উঁকি দেয় চকিতে। এ যেন আপন প্রয়োজনেই প্রায় অগোচরে তৃষ্ণা মিটিয়ে নেওয়া, যা এমন কিছু মহান নয়, কিংবা গল্প নয়; অন্যদের বোকা বানানোর কোনো হীন উদ্দেশ্য থাকে না তাতে। মন্টু মঞ্জু গোর্কি ট্যামবল এরা সবাই যেন কি—