হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না সরুদাসীর সঙ্গে। সরুদাসী যেন একটা কি।
দিগন্তজোড়া কোন জালের ভেতর থেকে প্রাণপণে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করে অনু।
একা একা বাগানে ঘোরে।
সব বাগানই এক একটা ছায়াচ্ছন্ন ইচ্ছের প্রতিকৃতি। বিন্যাসের কোনো অভাবই তাকে পীড়া দেয় না। সব বাগানেই মনে হয় কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি গোপন করা আছে। ভরে আছে কমলালেবু, পাকা আলুবোখারা আর স্কোয়শ ফলের গন্ধে।
এক সময় শুনতে পায় অভিশপ্ত ঘুঘুর ডাক আর রৌদ্রদগ্ধ চিলের পিপাসার্ত চিকার। তার নির্জন অন্ধকারে দানা বাঁধতে না পারা সব ধূসর আক্ষেপ-রৌদ্রের হিংসায় ফুঁসে ওঠা তপ্ত বাতাসের হাহাকারে আর দিঘিরটলটলে নীল দুঃখের মতো পাখিদের নির্জন আর্তনাদের দিমণ্ডলে নিঃশব্দে মৃত্যুর মতো পরিব্যাপ্ত হয়ে যায়।
এখন সরুদাসী এক নির্জন কষ্টের নাম। তার মনে হলো সে যেন দড়াম করে বাজপড়া একটা কালো কুচকুচে প্রচণ্ড শব্দ নিয়ে দিকভ্রান্তের মতো খেলছে; কোনোদিনই পৃথিবীতে সরদাসীকে পাওয়া যায় না। পোড়া ঘাসের আস্তরণে পড়ে থাকা কলাগাছের শুকনো বাসনায়, নোনাধরী পুরোনো পাঁচিলের গায়ে ঘুটের চিমসে গন্ধে, মেচেতা পড়া আকাশে,—তার স্নান নাম লিখে গিয়েছে সরুদাসী। সুচারু আনন্দের গোপন তহবিলগুলো তসরুফ করে সে চিরকালের মতো উধাও হয়ে গিয়েছে।
সারা দুপুর টো-টো ঘুরে, ঘোড়ার মতো গলায় ঝালর দোলানো বাতাসের কাছে, সন্ধানী আলোর কাছে, সে শুধু সেই একফোটা সদাসীকে রুজু করে বেড়ালো।
এক সময় টোকানির সঙ্গে দেখা পথে।
হাতে তুরপুণ আর র্যাদা নিয়ে শুকনো মুখে একই পথ ধরে আসছিলো সে। অনু দাঁড়িয়েছিলো ঝুরিওলা গম্ভীর বুড়োবটের নিচে। উপরে শকুন ডাকছিলো বিশ্রীভাবে, আর ঝটপট ঝটপট ডানা ঝাপটানি।
তাকে দেখে টোকানি বললে, খারায়া খারায়া করচ কি? এমনিই দাঁড়িয়ে আছি, তুমি কোথায় যাচ্ছো?
টোকানি মুখ খারাপ করে বললে, বাপ হালায় এগুলি বেচবার দিচে, অহনে কি করি ক-তো, হালায় হিয়ালের পোরা লইবার চায় না, কয়কি চুরি কইরা লইয়াইচস বুবি।
বিক্রি কেন?
টোকানি বিরক্তি উগরে বললে, বাপ এলায় এক হপ্তাথন বেমারিতে পইড়া রইচে, খায়ালয়া বাঁচতে অইবো তো!
অনু খুব অবাক হয়। এই মুহূর্তে টোকানির চোখে-মুখে দুঃখের ময়লা ছাপ সুস্পষ্ট ধরা যায়। তার সারা মুখমণ্ডলে উৎকট বিরক্তি আর যন্ত্রণার ধার অদ্ভুতভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। ব্রিং খেলার সময় এইসব মুখচ্ছবি এক অবিশ্বাস্য ইন্দ্রজালে ভিন্ন কিছুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
কি, হয়েছে কি তোমার বাবার?
কী আবার অইবো, যা অওনের তাই, চিকি! হাসপাতালে দাও নি কেন? টোকানি বললে, অইবোটা কি হুনি? হায়াৎ থাকলে এ্যামনেই ফরফরাইয়া চাঙ্গা হয়া উটবো।
অনু সহানুভূতির সুরে বললে, আমার কাছে কিছু পয়সা হবে, লাগলে দিতে পারি।
ঈমানে? তর রহম পোলা দেহি নাই, হচাই, কসম কইরা কইতাছি টোকানি ব্যাকুল হয়ে বললে, আল্লায় তরে হায়াৎ দেউক।
দুটো আধুলি পকেটে রেখে বাকিগুলো সব টোকানির হাতে দিয়ে দিলো। অনু।
টোকানির চোখজোড়া মুহূর্তেই উজ্জ্বল আধুলি দুটোর চেয়েও চকচক করে উঠলো। তার ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বললে, আল্লায় দিলে তগো কিছু কমতি নাই, ঠ্যাকা-বেঠ্যাকা নাই, আমগ য্যামুন ফুডা নসিব, আধুলি দুইডা দিয়া দে বন্দু—কিরা করা কইতাছি গরে এউগা দানাও নাইক্কা!
আধুলি দুটো ওর প্রসারিত হাতে দিয়ে অনু বললে, চলো না, তোমাদের ঘরটা দেখে আসি।
টোকানি খুব খুশি হয়ে বললে, হাচা কইতচিস?
রেললাইন পার হয়ে বেশ অনেকদূর যেতে হয়। জলাভূমির মাঝখানে এখানে-ওখানে উঁচু-উঁচু ঢিবি, পথে তিন-তিনটে বাঁশের সাঁকো। খানা খন্দের পাশে টোকানিদের ঘর। সারি সারি অনেকগুলো খুপরি। সর্বত্রই আবর্জনার স্তুপ আর ভাঙা প্যাকিং বাক্সের পাহাড়। কয়েকটা ন্যাড়ামুড়ো সুপুরি গাছ শূলের মতো আকাশকে বিধছে; বিধ্বস্ত রাজপাটের বধ্যভূমির শেষ চিহ্ন ওগুলো, তাই মনে হয় অনুর।
টোকানির মা তাদের একচালা ঘরের কাদা থুথুকে উঠোনে বসে হিঞ্চা বাছাই করছিলো। সব মিলিয়ে দুটাকা চার আনার মতো দিয়েছিলো অনু টোকানিকে। টোকানি তার মার হাতে পাঁচসিকে পয়সা গুঁজে দিয়ে বললে, কর্জ কইরা আনলাম, ঐগুলি কেউ লইবার চায় না।
ঘরের ভেতর চৌকির ওপর মশারি খাটিয়ে তার ব্যাধিগ্রস্ত বাবা শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছিলো। টোকানিকে কি একটা গাল দিলেও স্পষ্ট শুনতে পেলো না অনু। উঠোনের এক কোণে ছোট্ট একটা ঘ্যানঘেনে মেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে চোখ-নাক ভাসিয়ে আপন মনে নাকিসুরে কেঁদে চলেছে।
টোকানি বললে, তুই অহনে যা গিয়া, কাউলকা দেহা অইবো।
কিছুদূর এগিয়ে এসে অনুর কাঁধের ওপর একটা হাত রেখে ভারাক্রান্ত গলায় পুনরায় বললে সে, ট্যাকাটার কথা মনে থাকবো আমার। যহন রিশকা চালান দরুম তগো সবতের সব পসা হিশাব কইরা অক্করে পাইতক দিয়া দিমু!
চালার ভেতর থেকে টোকানির বাবা করকরে গলায় হঠাৎ চিৎকার জুড়ে ওর মাকে উদ্দেশ করে বললে, হড়ি-হাবাইতা পোলার খেতায় আগুন, খেদায়া দাও হালারে, লাশ বানায়া দিমু জুতায়া!
টোকানি মুষড়ে পড়ে বললে, তগো বাপে এ্যামুন কয় নিকি, হালায় হেটের মদে যেমুন ঘুড্ডির মাজা দিয়া লইচে!
কি বলবে অনু, বোকার মতো টোকানির দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
টোকানি ছলছলে চোখে তার একটা হাত চেপে ধরে ধরাগলায় বললে, বহাইতে পারলাম না বন্দু, দেখলাইতো আমাগো সব, নিজেগই দানাপানি নাই তো তরে আর কি খিলামু!