অনু প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে নিতান্ত অসহায়ের মতো বললে, আমি তো তোমার জাত তুলি নি–
তা তুলবি কেন, সে সাহস থাকলে তো! শুধু আড়চোখে ঠারেঠোরে আমার পাছা দেখছিলি হ্যাংলার মতো, অসভ্য বাঁদর কোথাকার। পচা মায়ের পেটে জন্ম।
অনুর মাথায় রক্ত চনমন করে উঠলো একথায়।
এক পলকে একটা গজারির চেলা উঁচিয়ে সে ওর সামনে গিয়ে বললে, মা তুললে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি, চুরমার করে দেবো মাথা!
সরুদাসীও একটা চেলাকাঠ হাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে এসে বললে, ওরে মিনমিনে চাঁদমুখো শয়তান, তোর পেটে পেটে এতো বজ্জাতি! আমিও ছাড়বো ভেবেছিস, আমি কি ননীর পুতুল? কুত্তা কোথাকার। আগাপস্তলা চুরিয়ে দেবোমার না। মার না! মার না।
ভালো হবে না ভালো হবে না–
যাযাহ্!
আমি কিন্তু–
কতো না তোর মুরোদ, শুয়োর–
অনেকক্ষণ জোরে জোরে নিশ্বাস নিলো অনু। কোনো কিছু ভেবে না পেয়ে চেলাকাঠটা এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে সেই ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় করে ছুটে বেরিয়ে গেল।
ঝাঁপের ফাঁক দিয়ে গলা বের করে সরুদাসী চিৎকার জুড়লো, মর মর, মাথায় বাজ পড়ে মর! তুই আমার—তুই আমার মুড়োঝাটা! গয়েরখেকো, খ্যাংরা মারি তোর মুখে।
০৯. নিয়মিত স্যার আসেন
নিয়মিত স্যার আসেন; ইংরেজি শিখছে মা। সবকিছুই সেই আগের মতো। ঘরের ভেতর শয়তানের ঠাণ্ডা লাল চোখ। তোশকে ঘুষঘুষে জ্বর। ফরাশে দুঃস্বপ্ন। ফরাশে রক্ত। ফরাশে চৌচির হয়ে নিজের মৃতদেহ দেখতে পায় অনু।
হঠাৎ এ রকম করলো কেন সরুদাসী!
কদিন থেকে ক্রমাগত ভেবেছে সে, কোনো সূত্র কোনো সদুত্তর খুঁজে পায় নি এ যাবৎ। কেবল মনে হয়েছে সরুদাসীর অনেক কিছুই উহ্য, অনুক্ত, সামঞ্জস্যহীন।
কোনোদিন তাকে এমন মর্মান্তিক নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় নি।
সরুদাসীর সেই রুষ্ট ধারালো মুখের ছবির কথা মনে পড়লেই অনু কেন্নোর মতোই কুঁকড়ে যায়। রাগান্ধ গরগরে এক রাক্ষসের তাড়া খেয়ে গহন অরণ্যে বিপন্ন অনু পথ হারিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে রহস্যলোলুপ অনিশ্চিত এক কুহকে।
ব্যাকুল বিস্তীর্ণ দুপুর নিরাকার কষ্টের প্রতিকায় হয়ে বাইরে থেকে জানালার গরাদ ধরে অবসন্নের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। অনুর মনে হয়। অবসাদ আক্রান্ত এই ছত্রাখান দুপুরের গা থেকে, সরুদাসীর রুক্ষ ভাসমান চেহারা থেকে, রক্তের প্রচণ্ড ভাপ উঠছে। করকর করকর জ্বালা করতে থাকে চোখ, মাথা ভারি হয়ে যায়; ফ্যাকাশে রুগ্নতা কি বিকট মুখব্যাদান করে থাকে!
পকেট বোঝাই রেজগি নিয়ে নিদ্রিত শয়তানের থাবা থেকে পা টিপে টিপে আবার বের হলো সে। মাঝে বন্ধ ছিলো বাইরে যাওয়া; আবার অনিচ্ছা ও জন্মান্ধ শাসনের সারি সারি উদ্ধত বর্শার ফলক টপকে বুক পেতে রাখা ধূলি-ধূসর উদাসীনতায় নেমে এলো।
হাম্মাদের দোকানের পেছনে ফালানি, ফকিরা, গেনদু, মিয়াচাঁন, লাটু, সবাই আছে, কেবল টোকানিকে কোথায় দেখা গেল না।
গেনদু বললে, কই থাহচ, কিরে তরে দেহি নাক্যান?
অনু সংক্ষেপে বললে, জ্বর হয়েছিলো!
ইচ! চ্যারা অক্করে পানিৎ পচা ট্যাংরার লাহান আউলাইয়া গ্যাছে তর। মাজারে হিন্নি দিচস?
না। শাসাব বাইৎ গেচস?
না।
হাতে শুঁয়োপোকা লেগেছিলো গেনদুর, হাতের পাতায় ঘসঘস করে ডুমুরপাতা ঘষতে ঘষতে বললে, তগো এলায় জাইত-ধর্ম কিছুই নাই!
মেথির গূঢ় গন্ধে মৌ-মৌ করছিলো চতুর্দিকে। হাম্মাদের নাক ডাকানি স্পষ্ট কানে আসে। অন্যান্য দিনের মতোই পরম নিশ্চিন্তে অকাতরে ঘুমোচ্ছে হাম্মাদ। দোকানের ভেতরের বাঁশের ঝালিতে রাখা কচুপাতার মোড়ক থেকে পিঁপড়ের একটা বহর বাইরের দিকে বয়ে চলেছে, তাদের মুখে সুজির গুঁড়োর মতো ডিম।
গেনদু বললে, বুঝচস কি অইতাচে? এলায় হাম্মাদের পো হাম্মাদের অক্করে তেরোডি বাইজা গ্যাছে। পিরপাগুলি ক্যামুন ব্যাব্যাক আণ্ডাটি ফিরত লয়া যাইতাচে চায়া দ্যাখ!
ভালো লাগলো না অনুর। হেঁড়া অংশটুকু কিছুতেই অর জোড়া লাগতে চায় না, বিশ্রী একঘেয়ে মনে হয়। তাদের অগোচরে অন্যদিকে সরে পড়লো সে সুযোগমতো।
এমন সব দুপুরে দার্জিলিংয়ের গল্প করতো মা।
সাধারণত যখন খুব গরম, বুকের ছাতি ফাটানো রোদ বাইরে, ঘরের ভেতরেও আগুনের হলকা, মনের রাশ আলগা করে দিতো মা। এইসব গরমের দিনে ফ্রিজ থেকে বের করে আনা বরফ গালে গলায় বুলানোর চেয়ে দার্জিলিংয়ের গল্প তার ভালো লাগতো। কাঞ্চনজঙ্ঘার গল্প তো ছিলোই সেই সঙ্গে বাংলোর বুড়ো দারোয়ান বিজয়বাহাদুর থাপাড়ের রোমাঞ্চকর সব বৃত্তান্ত। বিজয়বাহাদুর যৌবনকালে যখন শেরপার কাজ করতো তখন নাকি সে স্বচক্ষে বরফের ওপর বারোফুটের এক তুষার মানবকে ছুটে যেতে দেখেছিলো।
সব কথা ঠিকমতো মনে পড়ে না এখন।
ধীরে ধীরে গুলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু, স্বাদহীন হয়ে যাচ্ছে, আগের ক্লাসের বয়ের মতো সব যেন পাণ্ডুর, নিরর্থক।
এখন সে সরুদাসীকে রীতিমতো ভয় পায়। সেধে দেখা করতে যাওয়ার সাহস তার নেই। কেবল একটা ইচ্ছে দুরন্ত ঘূর্ণির মতো বারবার পাক খেয়ে কালো অন্তরালের ছেঁড়াফোঁড়া খেদ, বিবর্ণ ভীতি, যাবতীয় জঞ্জাল, ফরফর করে ওড়াতে লাগলো; ইচ্ছেটা এই—জরাজীর্ণ চিৎপাত দুপুরে তন্নতন্ন করে সরুদাসীকে খোঁজা। নির্দিষ্ট কিছু একটার মধ্যে ডুবে থাকার জন্যেই কতকটা। ঠিক ইচ্ছে নয় তাকে খুঁজে পাবার, মুখোমুখি হবার, অথবা ভাব জমিয়ে কথা বলার। বারবার আকুলভাবে তার মনে হতে থাকলো সরুদাসীর সেই রুক্ষ মলিন চেহারা, ছেঁড়া ময়লা কাপড়, কোমরের কড়িবাঁধা লাল ঘুনসি, ইত্যাদি সব; পরাক্রান্ত দুপুরের লোভী হাত কিভাবেই সে সব গেড়ে ফেলেছে মাটিতে।