অনু প্রতিবাদ করে বলে, পড়তেও হয়।
পড়ে ঘণ্টা হয়! পড়লে বুঝি সব জানা যায়? তুই জানিস কি করে জুতো সেলাই কত্তে হয়? কটা লোক ঠিকমতো জুতো সেলাই কত্তে পারে, বুকে হাত দিয়ে সত্যি করে বল দিকি। শ্রীনাথ জ্যাঠা তো সকলের মুখের ওপর পষ্ট করে বলেই। বলে কাজের কী জানিস তোরা, ফাঁকি মেরে কোনো মতে জোড়াতালি দিয়ে কাজ করছিস, একে জুতো সেলাই বলে না, গোঁজামিলের কাজ, জোচ্চুরি করে পয়সা নিচ্ছিস, জুতো সেলাই অতো সোজা নয়, শিখলি কবে তোরা যে পারবি, এইজন্যেই তো ঋষিদের ঘরে ভাত এমন বাড়ন্ত এখন।
অনু বললে, ও আর এমন কি কঠিন কাজ! ইশ, জুতো সেলাই কত্তে কত্তে বাবুর হাতে কড়া পড়ে গেছে কিনা, উনি সব জানেন! যত্তোসব হেঁদো কথা তোর। শ্রীনাথ জ্যাঠা ঋষিপাড়ার ফঁকিবাজ ছোড়াগুলোকে তো বলেই, বলে সব কাজই কঠিন, তাকে ভালোবাসতে হয়, নিজের মাগী করতে হয়, মাগী করলি তো ধরা দিলো, তোর যে মাগী সে তোরই জানা। পায়ের জুতো পায়েই থাকবে মাথায় উঠবে না কখনো—স্রেফ গোজামিল দিয়ে চালা, এই যদি তোর মনের কথা হয়, তাহলে শিখবিটা কেমন করে। পায়ের সেবা করলেই মাথা পাবি, মাথার মধ্যেই সব, মাথার মধ্যে বিশ্ব!
অনু বললে, আমাদের কুইনিনস্যারও এই ধরনের কথা বলেন।
সরুদাসী বললে, আচ্ছা বিশ্ব মানে কি রে?
তোমার শ্রীনাথ জ্যাঠা বলে নি?
চালাকি মারা হচ্ছে? জানিস না তাই বল। পড়লে কি আর সবকিছু জানা যায়, সেই কথাই তো বলছিলাম। নাভির ওপর কোন্ গাছের শেকড় রাখলে তাড়াতাড়ি বাচ্চা খালাস হয় বল দিকি, দেখবো কেমন সরেস তোমার ঐ হেঁড়েমাথাটি?
নিরুত্তর অনু নিষ্পলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
বৃষ্টির শোঁ-শোঁ শব্দে কান পেতে এক সময় সরুদাসী প্রগাঢ় আচ্ছন্ন কণ্ঠে তাকে জিগ্যেস করলে, হ্যারে মনসাপাতা, আমাকে তোর কেমন লাগে সত্যি করে বল না।
খুব ভালো।
সত্যি করে বলছিস?
সত্যি!
দিব্যি?
তাই! তুই আমাকে বিয়ে করবি?
অনু একথার কোনো উত্তর না দিতে পেরে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো।
বুঝেছি–দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সরুদাসী সকাতরে বললে, আসলে আমাকে তোর একরত্তিও পছন্দ নয়, একটা আস্ত মিথুক তুই। আর পছন্দ হবেই বা কি করে, বুঝি সব, আমরা তো আর বাবুজাতের মেয়েদের মতো চোখ কানের মাথা খেয়ে বেহায়াপনা কত্তে পারিনে। বুক উইঢিবির মতো উঁচ করে, পাছা দুলিয়ে, রঙ-চঙ মেখে, অন্যদের বোকা বানিয়ে মন ভাঙানো আমাদের ভেতরে নেই বাপু। আমরা যা—তাই!
অনু বললে, সত্যিই আমি তোমাকে পছন্দ করি, সত্যি বলছি।
মিথ্যে কথা, ডাহা মিথ্যে কথা!
একটুও মিথ্যে নয়!
তুই আমাকে ঘেন্না করিস!
বলেছে—
হরিয়া কিন্তু আমাকে ঘেন্না করে না।
আমিও করি না।
তুই একটা হাঁদু–রাঙামুলো!
বেশ তাই!
বাবুর বুঝি রাগ হলো? আচ্ছা আচ্ছা, আর বলবো না, এই ঘাট মানছি। তুই একটুতেই বুঝি চটে যাস, গায়ে মাছি বসতে পারে না—বাব্বাহ! আমি কি আর সত্যি সত্যিই তোকে রাঙামুলো বলেছি, ওতো ঠাট্টা। তোর সঙ্গে ঠাট্টা না করলে আর কার সঙ্গে করবো বল? তুই না আমার মনসাপাতা, গুলে খেয়ে ফেলেছিস বুঝি এরি মধ্যে?
তাতে হয়েছে কি?
তোর মাথায় শুধু গোবর। ইশ কি বিষ্টিটাই না হচ্ছে! যেন আকাশ ফুটো হয়ে গিয়েছে।
কি করে ঘরে ফিরবে?
দোলায় চেপে।
তার মানে?
বুঝলি না বুঝি?
সত্যিই বুঝি নি—
যাক অতো বুঝে কাজ নেই, যা সরেস মাথা তোর।
খিলখিল করে হাসতে হাসতে পাল্লার দড়ির গায়ে ঠেস দিলো সরুদাসী, তারপর হাসির দমক সামলে নিয়ে বললে, তোর কাঁধে চেপে, বুঝলি রে, গোবর-গণেশ কোথাকার!
বয়েই গেছে আমার—
কেন, তুমি বুঝি স্কন্ধকাটা, সেইজন্যে কাঁধে নিতে পারবে না? তবে লেজে বেঁধে টেনে নিয়ে যাবি!
হেসে উলটে পড়লো সরুদাসী।
পরে কি ভেবে আবার বললে, কিরে, নিয়ে যাচ্ছিস তাহলে কাঁধে করে?
ধরো নিয়েই গেলাম, তোমাকে বাড়ির কেউ বকবে না?
বয়েই গেল, বয়ে গেছে আমার ঘরে ফিরতে। কপালে যা আছে তাই হবে!
কি করবে?
তোর গলা জড়িয়ে ঐ চৌকিতে শুয়ে থাকবো। চলনারে, তোতে আমাতে শুয়ে থাকি!
তুমি যাও।
রাগ করেছিস বুঝি? গোবর-গণেশ বলেছি তাই? মনসাপাতাকে অমন অনেক কথাই শুনতে হয়। চলনা ভাই! বুঝেছি তোর লজ্জা করছে, কেউ এখানে দেখতে আসছে নাকি আমাদের? আমরা তো শুধু গলা ধরাধরি করে চৌকিতে শুয়ে থাকবো।
আজ থাক আর একদিন হবে—
ভয় করছে বুঝি?
না, তোমার গায়ে কেমন যেন আঁশটে গন্ধ। এত নোংরা থাকো কেন
তুমি?
সরুদাসী প্রায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললে, মরার কথা শোনো। গন্ধ আবার কোথায়! তোর নাকে গন্ধ। আমরা তো আর বাবুজাতের লোক নই। তোরা তো আমাদের চেয়ে অনেক নিচুজাত।
অনু ক্ষীণকণ্ঠে আপত্তি করে বলে, বললেই হলো আর কি!
তবে কি? সরুদাসী ভঁটো মেয়েমানুষের মতো খাড়া হয়ে মাজায় একটা হাত রেখে তর্জনী উঁচিয়ে বললে, তোদের ঠাকুর-দেবতা আছে? তোরা পুজো করিস? মরা মুরগি খাস? বল না, চুপ করে আছিস কেন?
অনু ঝট করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললে, আমাদের জাত সব জাতের চেয়ে বড়।
সরুদাসী ধারালো কণ্ঠে বললে, অতোই যদি বড় তাহলে যেচে মিশতে আসিস কেন? কাদের জাত কতো বড় সে আমার খুব ভালো করেই জানা আছে, আমি কচি খুকি নই। কি ঝগড়াটে ছোঁড়া—ইশ!
অনু বললে, আমি আবার কখন ঝগড়া করলুম?
ন্যাকা! জাত তুলে কথা বলতে লজ্জা করে না তোর? যার যার জাত তার নিজের কাছে। তোর জাত নিয়ে কি আমি দুবেলা ধুয়ে খাবো, না তাতে আমার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার হয়ে যাবে? বলতিস এসব হরিয়ার কাছে তো জলবিছুটি দিয়ে ঝড়িয়ে আচ্ছামতো ঢিট করে দিতো। ওর প্যাদান একবারটি খেলে বাপের নাম আর মনে থাকবে না। যা, ভাগ এখান থেকে।