পেয়েছি পেয়েছি, কি মজা–বলে এক সময় ছুটে গেল ক্যাশবাক্সের কাছে, তারপর তার ভেতর থেকে বের করলো একটা কাঁচা আম ঘষা ঝিনুক আর নুনের পুঁটলি। ওলন-দোলন ওলন-দোলন এই বলে সে দোলনা চাপার মতো করে পাল্লার একদিকে বসে অপরদিকের দড়িআঁটা। তক্তায় বসতে নির্দেশ করলো অনুকে। সরুদাসীর দিকটা খানিক উঁচুতে উঠলো।
সরুদাসী একটু পরে হেসে বললে, তুই ভারে কাটিস, আমি ধারে কাটি, তাই না?
অনু বললে, ঘোড়ার ডিমের কথা, মাথামুণ্ডু নেই!
আমার ধার ঘষা ঝিনুকের চেয়েও কিন্তু বেশি, বুঝেশুনে কথা বলিস! আমের গা থেকে ঝিনুকের ফুটো দিয়ে খোসা ছাড়িয়ে কেটে কেটে গালে পুরে চিবুতে লাগলো সরুদাসী। কখনো এক চিমটি নুন নিলো। কখনো মাড়িতে নিয়ে চিবুলো। কখনো টকাস টকাস করে শব্দ তুললো টাকরায়।
এক সময় বাইরে বৃষ্টি থেমে এলো। প্রচণ্ড শব্দে ঢেউটিনের চালের ওপর দুড়ুম-দাঁড়াম্ শিল পড়া শুরু হলো। মনে হয় ডাকাত পড়েছে, বর্শা ছুড়ছে এলোপাতাড়ি।
শিলপড়া বন্ধ হলো আবার।
আবার বৃষ্টি শুরু হলো।
বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি!
এবারে একেবারে আকাশ ভেঙে।
অনুর মনে পড়ে যায় চল নামি, আষাঢ় আসিয়াছে—যদিও বৈশাখ চলছে এখন। চলো নামি, বৈশাখ আসিয়াছে, তাই বৃষ্টির ঢল নামছে, আকাশ ফুটো হয়ে গিয়েছে।
সরুদাসীর পরনে শাড়িছেঁড়া ফালি লুঙ্গির মতো জড়ানো। গায়ে ঘটির মতো ফোলাহাতা ছিটের ব্লাউস, যার একটাও বোতাম নেই, নাভির উপরে। গিটমারা। কোমরে কড়িবাঁধা লাল ঘুনসি। ভিজে কাপড়ে ছুটতে গিয়ে পিছনের দিকে খানিকটা ফেঁসে গিয়েছিলো। সরুদাসী ছেঁড়া জায়গায় হাত রেখে হঠাৎ মুখ কালো করে তিরস্কারের সুরে বললে, তুই কি অসভ্যরে, হাঁ করে আমার পাছা দেখছিলি বুঝি এতোক্ষণ?
অনু লজ্জিত হয়ে বললে, যাঃ, মিথ্যে কথা!
ঠিক আছে, আর দেখিস না কখনো। তুই আর আমি যদি স্বামী-স্ত্রী হতুম তাহলে কিন্তু তোকে একথা বললে আমার পাপ হতো। বিশুয়ালালটা কি অসভ্য জানিস? শুধু পুতপুতু করে আর আমার পাছা দেখতে চায়। একটা আস্ত ভীতুর ডিম। এক ধমকেই আবার লেজ গুটিয়ে সুড়সুড় করে পালায় মেনিমুখো ছোঁড়াটা। কিন্তু হরিয়াটা একটা আস্ত গুণ্ডা। ওর গুণ্ডামি একদিন বার করবো আমি, ছাইকপালে। সেদিন বাগানে না তুই আবার মন্দ ভাববি, তোকে বলবো না। জানিস আমার মায়ের একটা খুব সুন্দর রুপোর গুজরি আছে। বিয়ের সময় আমাকে দিয়ে দেবে সেটা, মা নিজমুখে বলেছে।
অনু হাঁপানি রুগীর মতো ঘড়ঘড় শব্দ তুলে বললে, হরিয়ার কথা বলবে না?
সরুদাসী চট করে বললে, এমন গুণ্ডা তোকে আর কি বলবো! কথায় কথায় কুটকাট কোমরে চিমটি দেবে আর ছুতোনাতা করে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিশফিশিয়ে কেবল খারাপ খারাপ অসভ্য কথা বলবে। যা ঘেন্না করে আমার, ছি করো! সেদিন বাগানে আমার সঙ্গে রান্নাপাতি খেলা খেলতে খেলতে বলা নেই কওয়া নেই হুট করে বুকে খামচি কেটে দে দৌড়, নচ্ছার একটা! বড় জ্বালায় ছোঁড়াটা!
অনু গম্ভীর মুখে অভিযোগের সুরে বললে, তুমি তো বকতে পারো ওদের, তোমার মা-বাবাকে বলে দিতে পারো।
তুই একটা আস্ত ইয়ে! এইসব নাকি আবার কাউকে বলা যায়, মরে যাই মরে যাই! আমি সেধে না মিশলেই হলো। ছোঁড়া তো নয়, প্যাকাটি! নচ্ছারটার দুকান দুরকম, আবার ট্যাগরাও। অমাবস্যার রাতে জন্মালে নাকি অমন ছিরি হয়। এমনও হতে পারে ওর মা এঁটো হাতে পেচ্ছাব করতে বসেছিলো কখনো। একদম মড়াখেকো চেহারা, ওর মিছরি নিতে আমার বয়েই গেছে।
অনু বললে, তুমি যদি ওদের সঙ্গে আর কথা না বলো তোমাকে বাড়ি থেকে সুন্দর সুন্দর জিনিশ এনে দেবো।
ইশ, ওদের সঙ্গে ভাব জমাতে সরুর যেন আর ঘুম হচ্ছে না। আমি যেচে কথা বলি ভেবেছিস? বেহায়া কি আর গাছ থেকে পড়ে? কুকুর দুটো নিজেরাই নানান ছুতোয় সুড়সুড় করে পিছনে ঘোরে। এবার থেকে দেখা হলে গায়ে থুতু দেবো, তুই দেখিস। আমার আর কি দোষ বল, আমি তো আর এর আগে তোকে চিনতাম না। এই তোর নাম কি এখনো বললি না তো? আমারটা দিব্যি কায়দা করে জেনে নেওয়া হলো, বেশতো চালাকি!
অনু—
ওমা আমি কোথায় যাবো, ওতো হুঁড়িদের নাম রে! হেসে গড়িয়ে পড়লো সরুদাসী। তারপর চোখের নিক্তিতে হুট করে মেপে নিলো দুজনের বয়েস। অনুর চেয়ে কিছুটা বড়োই হবে সে, তার ধারণা। তবু কি যেন ভেবে খুব আন্তরিকতার সুরে সে বললে, নাহ্, নাম ধরে ডাকবো না তোকে। তুই বেশ আমার—তুই বেশ আমার মনসাপাতা।
অনু বুঝতে না পেরে বললে, সে আবার কি?
তোর মুণ্ডু! ওমা কি গাধারে তুই, মনসাপাতাও বুঝিস না, আবার নাকি গণ্ডায় গণ্ডায় বই পড়া হয়? বিশুয়ালাল আমার কি ছিলো জানিস, তেঁতুলপাতা!
আর হরিয়া?
বিছুটি পাতা!
উভয়ে নীরব থাকলো কিছুক্ষণ।
কান পেতে বৃষ্টির শব্দ শুনলো। মনে মনে বাজ পড়ার শব্দ গুনলো। বৃষ্টিভারাক্রান্ত হু হু হিমেল হাওয়া ঠিক ওদের মতোই ঝাপ ঠেলে ভেতরে ঢুকলো হুড়মুড়িয়ে কোনো এক সময়। ঝমঝমে বৃষ্টিতে ছাউনির করোগেট একটানা রিনরিনিয়ে উঠছে।
অনু বললে, আমি যদি রোজ আসি তুমি খেলবে তো?
বারে, খেলবো না কেন? সরুদাসী তার দিকে স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে বললে, তোর মিছরি খুব মিষ্টি, তোকে আমি খুব পছন্দ করি। বাবুদের বড় বাগান চিনিয়ে দেবো তোকে, সেখানে রোজ আমরা খেলবো। আচ্ছা মাগ ভাতার খেলা জানিস তো?
না!
তোকে সব শিখিয়ে দেবো। বাবুদের বাগানে কাটামুদি আর ভাঁটঝোপের ভেতর আমার খেলাঘর পাতা আছে, সেখানে তোতে আমাতে মাগ-ভাতার খেলা খেলবো। আমি মিছিমিছি চান সেরে ন্যাংটো হয়ে কাপড় বদলাবো, তুই চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকবি। দেখলে কিন্তু ভালো হবে না বলে রাখলুম। তারপর কাপড় পরে আমি তোকে বুকড়ি চালের মোটাভাত, কাঁকরোল-ভুষো চিংড়ি, মাগুরের ঝোল কিংবা জলপাই। কুচিয়ে দেওয়া গাংদাড় মাছের চচ্চড়ি দিয়ে পেটপুরে খেতে সাধবো। তুই মিথ্যে মিথ্যে রাগ করবি। বলবি, মেয়েটা কেঁদে কেঁদে সারা হলো সেদিকে খেয়াল আছে নচ্ছার মাগীর, মাই দিতে পারিস না, এইসব। পিচের কালো পুতুলটা বেশ আমাদের মেয়ে হবে। তারপর আমি তোর কাছে ঘাট মানবো। তুই ফিক করে হেসে ফেলবি। খেয়ে-দেয়ে দুজনে পাশাপাশি শোবো। তুই রাগ করে চলে যাবি। তারপর মিছিমিছি তাড়ি খেয়ে মাতলামি কত্তে কত্তে এসে আমাকে রানডি মাগী ছেনাল মাগী বলে যাচ্ছেতাই গাল পাড়বি। বেশ মজা হবে যাই বল, তাই না রে?