অনু বললে, তোমার বাবা কোথায় কাজ করে?
সরুদাসী কড়মড় করে দাঁতের মাড়ি দিয়ে মিছরি ভেঙে জড়িয়ে জড়িয়ে বললে, কি আবার করবে, জুতো সেলাই করে। ঋষিপাড়ায় সব্বাই তো ওই কাজই করে। অনেক ভালো ভালো কাজ পেয়েছে বাবা, কিন্তু ঠাকুরের মানা বলে সেসব করে নি। আমাদের জাত অন্য কিছু কত্তে গেলে ঠাকুরের শাপ লাগে।
অনু বললে, তোমাদের ঠাকুর বোধ হয় খুব রাগী?
কি জানি! প্রথমে উদাস থেকে তারপর চোখ বড় বড় করে সরুদাসী বললে, হ্যারে তোদের ঘরে অনেক জিনিশপত্তর, নারে?
অনু বললে, তা আর বলতে। অনেক দামি দামি সব জিনিশ, সব কাজেও লাগে না।
আবার উদাস হয়ে সরুদাসী আক্ষেপের সুরে বললে, আমাদের ওসবের কোনো বালাই নেই। বাবা সারাদিন রাস্তার মোড়ে লাইটের খাম্বার নিচে বসে জুতো সেলাই করে। সন্ধেবেলা যন্ত্রপাতির বাক্স মাথায় নিয়ে আবার ফিরে আসে। বগলি ঝেড়ে দুতিন টাকার বেশি কোনোদিনই নামে না। তারপর আবার চামড়া কেনা আছে, কাঁটা কেনা আছে। আমাদের খুব কষ্ট। এখন আগের মতো মাও আর তেমন বাইরে যায় না। কেউ ডাকেই না তো যাবে কি করে! আজকাল ধুমসী ধুমসী পোয়াতীরা গাট গ্যাট করে সোজা হাসপাতালে চলে যায় পয়সা বাঁচাবার জন্য। মদ্দা ডাক্তারের হাতে খালাস করায়। ঘেন্নায় আর বাচিনে বাপু! তুই বুঝি ইস্কুলে পড়িস?
অনু সগর্বে বললে, না পড়লে চলবে কেন। লেখাপড়ায় আমার সুনাম আছে। শক্ত শক্ত অনেক বই পড়তে হয়।
এতোটা বিশ্বাস হয় না তার, ঠিক এমনি সন্দেহের সুরেই সে বললে, যাহ, তুই বাড়িয়ে বলছিস!
সত্যি বলছি। অনু জোর দিয়ে বললে, প্রতিবারই আমি ফার্স্ট হই। সব স্যারেরাই আমাকে ভালোবাসেন!
এখন থাম—সরুদাসী অন্যদিকে তাকিয়ে নিস্পৃহকণ্ঠে বললে, আর বেশি বিদ্যে জাহির করতে হবে না।
অনুর মনে হলো তার একটুও বাড়িয়ে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। স্কুলে সত্যিই সে নামজাদা সুবোধ ছেলে। এমন কি অঙ্কস্যার ইয়াসিন লোদী (কুইনিনস্যার) আর বাংলার খিটখিটে রতিকান্ত কুণ্ডু (ক্যালসিয়ামস্যার) সবাই তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। সৎ এবং সুসভ্য ছাত্র হিশেবে সকলের মুখেই তার প্রচুর সুনাম। রতিকান্ত কুণ্ডু-খাই তোর মুণ্ডু কিংবা ব্ল্যাকবোর্ডে কুণ্ড দাবানল—এইসব যাচ্ছেতাই লেখার দলে সে কখনোই ভেড়ে নি। যেমন ইংরেজি টিচার টি. এ. লস্করকে নিয়ে ছাত্রদের বাজেকথা রটনা করাকে সে রীতিমতো ঘৃণা করে। লস্করস্যার (আন্ডারওয়ারস্যার) পাতলা ট্রাউজার পরেন বলে ছাত্ররা স্কুলময় রটিয়ে বেড়িয়েছে—স্যারের আন্ডারওয়ার দেখা যায় কেন, না উনি পুরোনো মশারির কাপড় দিয়ে ট্রাউজার তৈরি করনি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আকাশের একটা কোণে নিঃশব্দে মেঘ জমেছে। খুব আকস্মিকভাবে অল্পক্ষণের মধ্যেই আয়োজন শেষ হলো মেঘের, বলতে কি একবারে তাদের অগোচরে; দুজনের কেউই খেয়াল করতে পারে নি আসন্ন বর্ষণকে।
চোখের পলকে চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভরে গেল। ভালুকের গায়ের মতো এমন কালো অন্ধকার যে অনুর মনে হলো আর একটু পরেই তারা কেউই পরস্পরকে দেখতে পাবে না, খুঁজে পাবে না।
শীতল হাওয়ার স্রোত হঠাৎ খ্যাপাটে বুনো মোষের মতো যখন দাপাদাপি শুরু করলো তখন সরুদাসীর মুখ কালো হয়ে এলো, সে বললে, আই সেরেছে! উঠোনে ছাগলের শুকনো নাদি উঁই হয়ে রয়েছে, সব ভিজে
কাদা হয়ে যাবে। কপালে আজ নির্ঘাৎ পিটুনিলেখা আছে।
সেই অমল অন্ধকারে, দামাল হাওয়ায়, অনুর একবারও ঘরে ফেরার কথা মনে এলো না। মনে পড়লো একদিন বাড়ি থেকে কোথাও না কোথাও পালিয়ে যেতে হবে তাকে, সেখানে হয়তো ঠিক এমনই ঠাণ্ডা, হাওয়া, অন্ধকার।
কি যে করছে মা ভেতরে ভেতরে—জটিল মনে হয় অনুর, সব দরোজাই বন্ধ, উপায় নেই বোঝার। রাক্ষুসে ঘরগুলো সুযোগ পেলেই বিকট দাঁত বের করে তাকে দেখে হিংস্র হাসি হাসে। সাপের মতো হিলহিলে ভয় তাকে আষ্টেপিষ্ঠে জড়ায়; যেমন করেই হোক পালাতে তাকে হবেই—মনে করিয়ে দিতে হবে মাকে।
আর কতোদূর?
খুব কাছাকাছি এসে গেছি। ওরে, বিষ্টি পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে রে–
দৌড় মার, দৌড় মারা
অনু ব্রিত হয়ে বললে, এখন যে আমরা ভিজে চাবচু হয়ে যাবো। কচি খোকা, কথা শুনলে হাসি পায়! সরুদাসী মাথার ওপর হাতের তালু বিছিয়ে বললে, আমার পিছন পিছন চলে আয়, শিল পড়ছে।
কেঁপে বৃষ্টি এলো। পলকের মধ্যে ভিজে সপসপ হয়ে গেল অনু। চুটপুট চুটপুট গুড়ুম গাড়া করে বড় বড় শিল পড়ছে। অনু রোমাঞ্চিত হলো।
কি সুন্দর এই (ঝঞাঝরঝরঝাপতালঝিঝিঝিঝিট) বৃষ্টি! কি অদ্ভুত এই বৃষ্টি! কি সীমাহীন।
বৃষ্টি। বৃষ্টি!
বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি।
ফুঁসে উঠছে হাওয়া, কখনো গলায় ঘুঙুর বাঁধা বাছুরের মতো, কখনো কুঁদুলে ষাঁড়ের মতো শিঙ উঁচিয়ে; কখনো রনোন্মত্ত সিংহের মতো, দুর্দান্ত দস্যুর মতো কখনো।
ঢুকে পড় ঢুকে পড়, শিগগির ঢুকে পড়–বলে সরুদাসী একটা দোকানের ঝাপ ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে সাঁধায়।
অনুও ঢোকে তার পিছনে পিছনে। দোকানের ভেতরে কেউ নেই।
একটা ডালাভাঙা কাঠের ক্যাশবাক্স শীতল পাটি বিছানো চৌকির ওপর পড়ে আছে, কোণগুলো পিতলের নকশা দিয়ে মোড়া। এক পাশে থাক করা জ্বালানির চেলাকাঠ। মাঝখানে ঝোলানো বড়সড় একটা কাটাপাল্লা।
অনু ভয়ে ভয়ে বললে, বকবে না দোকানদার?
সরুদাসী নির্বিকারচিত্তে বললে, দেখলে তবে তো! আমরা তো আর চুরি কত্তে আসিনি, দেখলেই বা।
ফালুক-ফুলুক করে এদিক-ওদিক দেখতে লাগলো সরুদাসী; এমন সন্ধানী সে দৃষ্টি যেন কোনো কিছু একটা আবিষ্কার না হওয়া অবধি তার স্বস্তি নেই।