মায়ের চিঠি পৌঁছবার আগেই পারুলের চিঠি এল। নেত্রকোনা থেকে লিখেছে। লম্বা চিঠি। কিন্তু কোথাও নিজের বিয়ের কথা কিছু নেই। একবারও লিখেনি যে সে একটা ভুল করে ফেলেছে। তার দীর্ঘ চিঠির মূল বক্তব্য হচ্ছে, বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। মামারা টাকা পয়সা দেয়া বন্ধ করেছেন। আমি যেন যে ভাবেই হোক প্রতি মাসে মাকে টাকা পাঠাই। প্রয়োজন হলে কলেজ ছেড়ে দিয়েও যেন একটা চাকরি জোগাড় করি। বড় ডাক্তার দেখিয়ে যেন অতি অবশ্যি বাবার ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। চিঠির শেষে পুনশ্চ দিয়ে লেখা, দাদা দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আজকে আমার ওপর রাগ হলেও— সেদিন আর রাগ থাকবে না।
মায়ের চিঠিটি পাঁচ পাতার। ব্যাপারটি কি ভাবে ঘটল তা নিখুঁতভাবে লেখা। বৃহস্পতিবার সারাদিন পারুল নাকি শুয়ে শুয়ে কেন্দেছে। মাকে বলেছে পেটে প্রচণ্ড ব্যথা। শুক্রবার সকালে পরিষ্কার দেখে একটা শাড়ি পরে অঞ্জকে পুকুর ঘাটে নিয়ে একটি টাকা দিয়ে বলেছে ইচ্ছেমত খরচ করতে। মা একবার খুব ধমক দিলেন। পরিষ্কার শাড়িটা নষ্ট করছে সেই জন্যে। পারুল কিছু বলে নাই। দুপুরে খাওয়ার পর মাকে গিয়ে বলেছে, মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে বডড মাথা ধরেছে। মা ধমক দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। তারপর বিকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন পারুল ঘরে নেই …
সফিক সব কিছু শুনে বলল, তোর বোনটার তাহলে বুদ্ধি আছে দেখি?
বুদ্ধির কী আছে। এর মধ্যে?
বিয়ে করে নিজে বেঁচেছে তোদেরও রিলিফ দিয়েছে।
পরীক্ষণেই সে পারুল প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বললো, প্রতি মাসে তোর মাকে টাকা পাঠাতে হবে। এইটি খুবই জরুরি। আমি অবাক হয়ে বললাম, কোথেকে পাঠাব? টাকা কোথায়?
সবাই মিলে একটা চায়ের সন্টল দিয়ে ফেলি। আয়। খোঁজ নিয়েছি ভাল লাভ হবে। ম্যানেজার করে দেব নিশানাথকে। নিশানাথের দাড়ি গোফ দেখেই দেখবি হুঁড় হুঁড় করে কাস্টমার আসবে। চা বানিয়ে কুল পাওয়া যাবে না।
বলে কী সফিক। নিশানাথ জ্যোতির্ষিণব চায়ের দোকান দেবে? সফিককে দেখে মনে হল তার মাথার প্ল্যান খুব পাকা।
কাটা কাপড়ের ব্যবসাটা মাঠে মারা গেছে। ভাত খাওয়ার পয়সা নাই লোকে কাপড় কিনবে কী?
আমি বললাম, জ্যোতির্ষিণব বুঝি চায়ের দোকান খুলবে তোর সাথে?
না খুলে যাবে কোথায়? একটা লোক আসে না তার কাছে। ব্যাটার এখন ধূপ কেনার পয়সা নাই। সফিক ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। যেন খুব একটা হাসির ব্যাপার হয়ে গেছে। জ্যোতির্ষিণবের এমন দুর্দিন যায়নি কখনো। সঞ্চয় যা ছিল উড়ে গেছে। সখের টেবিল ফ্যানটি বিক্রি করেছেন করিম সাহেবের কাছে। আমাকে গম্ভীর হয়ে বললেন, সাধু সন্ন্যাসী মানুষদের জন্যে এই সব কিছু দরকার নাই। আমাদের কাছে হিমালয়ের গুহাও যা আবার সাহারা মরুভূমিও তা, ফ্যানের কোন প্রয়োজন নাই।
মিল চার্জ বাকি পড়ায় গত শনিবার থেকে খাওয়া বন্ধ। পরশু দুপুবে তাঁর ঘরে ঢুকে দেখি একটা শুকনো পাউরুটি চিবোচ্ছেন। আমাকে দেখে দারুণ লজ্জা পেয়ে গেলেন। কান টান লাল করে বললেন, আমিষ বর্জন করলাম, রঞ্জু। জ্যোতিষ শাস্ত্রের মত গূঢ় বিদ্যার চর্চা করলে মাছ মাংস সমস্ত বর্জন করতে হয়। আমার ঠাকুর দা শ্ৰী শ্ৰী তারানাথত চক্রবতী সমস্ত দিনে এক মুঠি আলো চালের ভাত আর একবাটি দুধ খেতেন। কি বিশ্বাস হয়? আমিষ একবার বর্জন করে দেখ শরীর ঝর ঝরে হয়ে যাবে।
রশীদ মিয়া উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছে। নিশানাথ বাবুর নাকি তিন মাসের সিট রেন্ট বাকি। জ্যোতির্ষিণব শুনলাম অতি গম্ভীর ভঙ্গিতে বলছেন, আর একটি মাস রশীদ মিয়া। এর মধ্যেই আমার মঙ্গল হোরায় প্রবেশ করবে। রবির ক্ষেত্র আবার…
আরে রাখেন। সাহেব মঙ্গল আর রবি। পনেরো দিন সময়। এর মধ্যে পারেন দিবেন না পারেন বিসমিল্লাহ বিদায়। তিন মাসের সিট রেন্ট আপনার দেওয়া লাগবে না।
জ্যোতির্ষিণবের এমন খারাপ সময় যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। তাকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করা যারে না। দান এবং ঋণ গ্রহণ, এই দুই জিনিস নাকি তার জন্যে নিষিদ্ধ। সফিক সবার সঙ্গে পরামর্শ করে বাংলা দৈনিক সব কটিতে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে দিল। একদিন পর পর সে বিজ্ঞাপন ছাপা হল এক সপ্তাহ পর্যন্ত।
‘পাক ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত জ্যোতিষ–শ্ৰী নিশানাথ চক্রবর্তী, জ্যোতির্ষিণব। এম. এ. (ফলিত গণিত) বহু রাজা মহারাজার প্রশংসাপত্র আছে। আসুন পরীক্ষা করুন। দর্শনী নামমাত্র।’
নিশানাথ বাবু বিজ্ঞাপন দেখে খুবই রেগে গেলেন। সফিককে গিয়ে বললেন, এম. এ. (ফলিত গণিত) এটা কোথায় পেলে? মিথ্যাচার করা হল। উফ কী তঞ্চকতা।
সফিক বলল, সবটাই তো তঞ্চকতা নিশানাথ বাবু। সবটাই যখন মিথ্যার ওপর কাজেই মিথ্যাটাকে আরেকটু বাড়ানো হল।
হাজার বৎসরের পণ্ডিতের সাধনালব্ধ জ্ঞান সবই মিথ্যা?
নিতান্ত মূঢ়ের মত কথাবার্তা। জ্ঞানহীন মুখের বাচালতা।
হিম কুন্দ মৃণালাভং দৈত্যাং পরং গুরু, সৰ্ব্ব শাস্ত্র প্রবক্তা ভার্গবং।
অংবং করে লাভ কিছু নাই নিশানাথ বাবু। এসব এখন ছাড়ার সময় এসে পড়েছে।
এত করেও নিশানাথ বাবুর অবস্থা ফেরানো গেল না। ঢাকা শহরের সব লোক হঠাৎ হাত দেখানো বন্ধ করে দিয়েছে কী না কে জানে। এমন খারাপ অবস্থা হবে জ্যোতির্ষাণবের স্বপ্নেও ভাবিনি। একদিন অনেক ভনিতা করে সফিককে বললেন, আমার একটা ভাল ঘড়ি আছে। এক ভক্ত দিয়েছিল। শুধু শুধু পড়ে আছে কোন কাজে লাগে না।