পরের মাসেও তার হাতে টাকা থাকে না। অল্প কিছু দিয়ে বলে, বাকি টাকাটা দিন সাতেক পরে চেয়ে নেবেন।
দিন সাতেক পর টাকা চাইলে মহা বিরক্ত হয়ে বলেন,
মাসের মাঝখানে আমি টাকা পাই কোথায় বলেন দেখি? বিচার বিবেচনা তো কিছু আপনার থাকা দরকার।
পড়াবার সময় কাছে বসে থাকেন। বাচ্চা দুটি এক সময় ঘুমে ঢুলতে থাকে। আমি উঠতে চাইলেই গম্ভীর হয়ে বলেন, এখনই উঠবেন কি দশটা তো বাজে নাই! হাতের লেখাটা আর একবার লেখান।
বাচ্চাদের উঠিয়ে নিয়ে চোখে পানির ঝাপ্টা দিয়ে আবার এনে বসান। মেয়েটি করুণ চোখে তাকায় আমার দিকে। বড় মায়া লাগে।
সফিকের সঙ্গে কথা বলে মাস্টারিটা ছেড়ে দিতে হবে। ওর সঙ্গে দিনের বেলা কাটা কাপড়ের ব্যবসা করে রাতে নাইট কলেজে পড়ব। সফিকের যদি লজ্জা না লাগে আমার লাগবে কেন? বাড়িতে সাহায্য করতে হবে।
আজ আর পড়াতে না গিয়ে সফিকের জন্য বারান্দায় মোড়া পেতে বসে রইলাম। করিম সাহেব আজও গায়ে তেল মেখে বারান্দায় মাদুরের উপর শুয়ে আছেন। আমার সঙ্গে আলাপ জমাবার চেষ্টা করলেন, নিশানাথের মাথায় এক বালতি ঠাণ্ডা পানি ঢাললে দেখবেন, মৌনব্রত কোথায় গেছে। ফর ফর করে কথা বলবে বুঝলেন, এসব ধান্ধাবাজি আমার কাছে বলবে না।
আমি চুপ করে রইলাম। করিম সাহেব বললেন, আরে ভাই লোক চরিয়ে খাই, আমার সঙ্গে চালাকি? মৌনব্রতের পাছায় লাথি।
সফিক ফিরল অনেক রাতে। চোখে-মুখে দিশেহারা ভাব। গায়ে আকাশ পাতাল জ্বর। জ্যোতির্ষাণব তার গায়ে হাত দিয়েই মৌনব্রত ভেঙে ফেললেন, চেঁচিয়ে বললেন, পানি ঢালতে হবে মাথায়। আর ডাক্তার লাগবে একজন।
সফিক চিচি করে বলল, ডাক্তার দেখিয়েই এসেছি। প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছে, টাকা থাকলে ওষুধ আনান। আমার কাছে নাই কিছু।
জ্বর বাড়তেই থাকল। সফিক আরক্ত চোখে নিশানাথের দিকে তাকিয়ে বলল, আয়ু রেখাটা দেখেন দেখি ভাল করে। এত সকাল সকাল মরলে হবে না। কাজ অনেক বাকি আছে।
নবী সাহেব, আজীজ সাহেব, করিম সাহেব সবাই এসে ভীড় করে দাঁড়াল। আমি জুরের গতি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
কিন্তু আশ্চর্য শেষ রাতের দিকে ঘাম দিয়েই জ্বর ছেড়ে গেল। সফিক ভাল মানুষের মত উঠে বসে বলল, ক্ষিধে লেগেছে, কি খাওয়া যায় বলেন দেখি নিশানাথ বাবু।
নিশানাথ জ্যোতির্ষিণব আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, বডড ঝামেলা হয়ে গেছে রঞ্জু। ভয়ের চোটে মানত করে ফেলেছিলাম। আজ রাতে জ্বর কমলে কাল দুপুরেই কাঙালী ভোজন করাব। হাতে পয়সা-কড়ি মোটেই নাই। এদিকে জ্বর তো দেখি কমেই গেছে। তারা মা ব্রহ্মময়ী একি বিপদে ফেললে আমাকে!
শীতের শুরুতে বাবা এসে হাজির
শীতের শুরুতে বাবা এসে হাজির।
খোঁচা খোঁচা দাড়ি সারা মুখে। গায়ে একটা ময়লা কোট। স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে গেছে। চেনা যায় না এমন।
মায়ের চিঠিতে স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা যে এতটা কল্পনাও করিনি। নিচের পাটির একটি দাঁত পড়ে গিয়ে এমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে!
ও রঞ্জু কেমন আছিস তুই? কতদিন পর দেখলাম।
আমি অনেকক্ষণ কোন কথাই বলতে পারলাম না। বার বার মনে হল বাবার মাথার দোষটা হয়তো সেরে গেছে। না। সারলে এত দূরে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে এলেন কী করে? তবু সন্দেহ যায় না। বার বার জিজ্ঞেস করি, মাকে বলে এসেছেন তো বাবা? না বলে আসিনি তো?
বাবা পরিষ্কার কোন উত্তর দেন না। একবার বলেন, হ্যাঁ বলেছি তো। আবার বলেন, বলব কি করে? তোর মা কথা বলে না। আমার সঙ্গে। ভাত খাওয়ার সময় আমি সামনে থাকলেও বলে, পারুল তোর বাবাকে খেতে বল।
আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাবাকে লক্ষ্য করি। কথাবার্তা বেশ স্বাভাবিক। আমার পরীক্ষা কবে, পড়াশুনা কি রকম করছি, এইসব খুব আগ্রহ করে জিজ্ঞেস করলেন।
রাতে হোটেলে ভাত খাওয়াতে নিয়ে গেলাম। সারাপথ গল্প করতে করতে চললেন। এখন আর গল্পের ধরন সে রকম স্বাভাবিক মনে হল না। যেন নিজের মনেই কথা বলছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ির সবাই ভাল আছেন। বাবা? বাবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ সবাই ভাল। স্টেশন মাস্টারের ছোট ছেলেটার হুঁপিং কফ হয়েছে।
পারুল, পারুল কেমন আছে? তার পরীক্ষা কবে?
জানি না তো। ভাল আছে নিশ্চয়ই।
আমি অবাক হয়ে বলি, পারুল কেমন আছে জানেন না বাবা? কী বলছেন এসব?
কী করে জানব, বোকার মত কথা বলিস? পারুলের বিয়ে হয়ে গেছে না?
আমি স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকি। এসব কী শুনছি?
কী বলছেন। আপনি? কিসের বিয়ে?
গত শুক্রবার পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। তোর মার এমন ভ্যাজর ভ্যাজার–পুলিশে খবর দাও, পুলিশে খবর দাও। মেয়েছেলেদের বুদ্ধি তো।
আমি বেশ খানিকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না। ভাবতেও পারছিলাম না তারা আমাকে একটা খবর জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করল না।
ছেলেটা ভাল। বেশ ভাল। পারুলকে নেত্রকোনায় নিয়ে গেছে। আমি ওদের কেন সঙ্গে গৌরীপুর পর্যন্ত গেলাম। আমার টিকিট লাগে না। ট্রেনের চেকাররা সবাই আমাকে চিনে। খুব খাতির করে।
বাবার কথাবার্তা শুনে চোখে পানি এসে গেল আমার। পারুলের মত মেয়ে এই করবে? পনের বছর যার বয়স! খবর দিলেন না কেন বাবা? একটা টেলিগ্রাম তো করতে পারতেন।
বাবা শান্ত স্বরে বললেন, তোর মা বলল, টেলিগ্রাম করলে শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা হবে। আমি চিঠি লিখব। মেয়ে মানুষের এরচে বেশি বুদ্ধি কী হবে? হলে তো আর মেয়েছেলে থাকত না। পুরুষই হয়ে যেত।