এমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস কেনার কথা মনে হয় সিরাজ সাহেবের। একবার কিনবেন সন্দেশ তৈরির ছাঁচ। সদরঘাট আর নিউ মার্কেট চষে ফেললাম দুজনে— কোথাও পাওয়া যায় না। সিরাজ সাহেবের মুখ শুকিয়ে পাংশু।
খুব করে বলে দিয়েছে নিতে। সখা হয়েছে একটা, ছেলেমানুষ তো। শেষ পর্যন্ত চক বাজারে পাওয়া গেল। সিরাজ সাহেবের গাল ভর্তি হাসি, যেন গুপ্তধন পেয়েছেন।
রাতে টিউশনি থেকে ফিরার পর সিরাজ সাহেব একবার আসবেনই আমার ঘরে। হাসি মুখে বলবেন, বারান্দায় হাওয়ার মধ্যে খানিকক্ষণ বসবেন নাকি রঞ্জু ভাই? পড়াশুনার ক্ষতি হলে থাক।
আমি রোজই গিয়ে বসি। এ-কথা সে-কথার পর সিরাজ সাহেব এক সময় বৌয়ের কথা এনে ফেলেন।
কোয়ার্টার পেলে নিয়ে আসতে হবে। ছেলেমানুষ একা একা থাকতে পারে বলেন দেখি? তার ওপর তার আবার ভূতের ভয়।
শিগগিরই পাবেন কোয়ার্টার?
অফিার্সাস গ্রেডে গেলেই পাব। সুন্দর কোয়ার্টার। বেড রুম দুইটা। বারান্দা আছে। ফুলের টব রাখা যায়। আপনার ভাবীর আবার গাছের সখ।
তাই নাকি?
আর বলেন কেন! গাছের নামে অজ্ঞান। এইবার হুঁকুম হয়েছে। রজনীগন্ধার চারা নিতে হবে। বিয়ে করার যে কি ঝামেলা, বিয়ে না করলে বুঝবেন না।
সিরাজ সাহেব কপট বিরক্তিতে মুখ অন্ধকার করতে চেষ্টা করেন। বারান্দার আবছায়া অন্ধকারেও কিন্তু তার হাসিমুখ ঢাকা পড়ে না। বড় ভাল লাগে আমার।
একবার ভাবীকে দেখতে যাব আমি আপনার সঙ্গে।
অবশ্যই অবশ্যই। এই শনিবারেই চলেন। কী যে খুশি হবে। না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। ওর কাছে আপনি পর কিছু নাই–সবাই আপন। যেতে হবে কিন্তু ভাই, ছাড়ব না আমি।
শনিবারে কিন্তু সিরাজ সাহেব যেতে পারলেন না। অফিসের কাজ পড়ে গেল। হঠাৎ করে। মুখ কালো করে ঘুরতে লাগলেন। রাতে খেতে পারলেন না। মোটেই নাকি ক্ষিধে নেই। রোববার ভোরে দেখি তার চোখ বসে গেছে। দিশেহারা ভাব। সারারাত নাকি ঘুম হয়নি। খুব আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছেন, দেখেছেন যেন একটা মস্ত বড় সাপ রেখাকে ছোবল দিচ্ছে। মনটা বড় অস্থির ভাই। চলেন দেখি নিশানাথের কাছে যাই।
নিশানাথ গম্ভীর মুখে শুনলেন সব কিছু। তার ভাব দেখে মনে ভরসা পাওয়া যায় না। কিন্তু কথা বললেন খুব নরম গলায়, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন তো— তাই এই সব দেখেছেন। এই সব কিছু না। শনিবার তো এলো বলে। বড় সাহেবকে বলে এই বার একদিন বেশি থেকে আসবেন।
কিন্তু পরের শনিবারে সিরাজ সাহেবকে অফিসের কাজে খুলনা চলে যেতে হল। সোমবার সন্ধ্যায় ফিরলেন। আমরা সিরাজ সাহেবের দিকে তাকাতে পারি না। নবী সাহেবের মত মানুষ পর্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, দেশে একটা টেলিগ্ৰাম করে দাও। চিন্তা করবে তো।
সিরাজ সাহেব দার্শনিকের মত মুখ করে বললেন, টেলিগ্রাম আর করে কি হবে?
পান্থ নিবাসের জীবনযাত্রা খুব একঘেয়ে বলেই বোধ হয়। সোমবার ভোরে আমাদের বিস্ময়ের সীমা রইল না। সবাই অবাক হয়ে দেখলাম রিকশা থেকে একটি ফুট ফুটে মেয়ে নামছে। এমন মায়া কাড়া চেহারা। হলুদ রঙের একটি শাড়িতে দারুণ মানিয়েছে। যদিও কেউ আমাকে কিছু বলেনি। তবু বুঝলাম। এই মেয়েটিই সিরাজ সাহেবের বৌ। একটা হুঁলস্থূল পড়ে গেল আমাদের মধ্যে। নিশানাথ জ্যোতির্ষিণব সিরাজ সাহেবকে ভাই বলে ডাকেন। তিনি অবলীলায় বলতে লাগলেন, এসো মা এসো। আসবে সিরাজ। যাবে কোথায়? অফিসের কাজে আটকা পড়ায় যেতে পারেনি। আজও সকাল সকাল চলে গেছে। এক্ষুণি আনতে লোক যাবে।
সিরাজ সাহেবের বেঁটি অল্প সময়ের মধ্যে সহজ হয়ে গেল। নিশানাথ বাবু এবং নবী সাহেব দু’জনকেই সে এমন সুরে চাচাজান ডাকতে লাগল যেন বহু দিন পর হারানো চাচা ফিরে পেয়েছে। নবী সাহেব দুবার রান্নাঘরে গিয়ে তদারক করলেন নাস্তা পানি কি দেয়া হবে। সফিক চলে গেল সিরাজ সাহেবের অফিসে। করিম সাহেব গন্তীর হয়ে ঘোষণা করলেন, আজ আর তিনি অফিসে যাবেন না। দুপুরের খাবারটা যেন ভাল হয় সেটা দেখাশোনা করা দরকার। কাঁদেরের ওপর ভরসা। করা যায় না। মেয়েটি মনে হল অভিভূত হয়ে পড়েছে। সে কখনো ভাবেনি এমন একটা সমাদর তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। সবার সঙ্গে সে এমন ভাব করতে লাগল যেন সেই পান্থ নিবাসে দীর্ঘদিন ধরে আছে। এখানকার সবাই তার চেনা।
সফিক সিরাজ সাহেবকে সঙ্গে করে এগারোটার দিকে এল। সিরাজ সাহেবকে কিছুই বলেনি সে। সিরাজ সাহেবের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। তিনি কাঁপা গলায় বললেন, আমার নাকি দুঃসংবাদ আছে?
জ্যোতির্ষিণবের দাড়ির ফাঁকে হাসি খেলে গেল। তিনিও যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় বললেন, যান দেখি সাহেব আমার ঘরে। দুঃসংবাদ তো আছেই। ঘরে গিয়ে বসেন ঠাণ্ডা হয়ে বলছি।
সিরাজ সাহেব ঘরে ঢুকতেই ঝপাং করে দরজা বন্ধ করে ফেলা হল। জ্যোতির্ষাণবের হাতে তালা মজুদ ছিল। তালা লাগিয়ে দেয়া হল দরজায়। আমাদের সমবেত হাসির শব্দে রাস্তায় লোক জমে গেল।
রাতের বেলা খেতে গিয়ে দেখি ফিস্টের ব্যবস্থা। এ মাসের বাজারের ভার আজীজ সাহেবের হাতে। তিনি কাউকে না জানিয়ে ফিস্টের ব্যবস্থা করেছেন। বাকি মাস সাবধানে বাজার করে তিনি নাকি সব পুষিয়ে নেবেন।
পান্থনিবাসে নিজেদের দুঃখ কষ্ট আমরা ভুলে থাকার চেষ্টা করি। তবু একেক বার মন ভেঙে যেতে চায়। বাড়ির চিঠি পড়ে আমার আজ বড় কষ্ট হচ্ছে। হাতে একেবারেই টাকা-পয়সা নেই। থাকলে আজ রাতেই বাড়ি চলে যেতাম। প্রাইভেট মাস্টারিটা ভাল লাগছে না। ভদ্রলোক কিছুতেই টাকা দিতে চান না। বেতন দেবার সময় হলেই অম্লান বদনে বলেন, এই মাসে একটা ঝামেলা আছে-সামনের মাসে নেন।