তোমার বাবার স্বাস্থ্য বিশেষ ভাল না। খাওয়া দাওয়ায় ইদানীং খুব অনিয়ম করেন। আমার সন্দেহ হয় তাহার অল্প অল্প মাথার দোষ দেখা দিয়াছে। পরে বিস্তারিত লিখিব।
চিঠি পড়ে খুব মন খারাপ হয়ে গেল। মা নিশ্চয়ই অনেক কিছু গোপন করেছেন। খুব অস্থির লাগল। সফিকের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন। কিন্তু সে আসবে রাত এগারোটার দিকে। বারান্দায় চেয়ার টেনে চুপচাপ বসে রইলাম। চার পাঁচ মাসে বাবার এমন কী হতে পারে যাতে মা ভেবে বসেছেন। বাবার মাথার দোষ হয়েছে। তা ছাড়া সংসার চলছে কি ভাবে সেই প্রসঙ্গেও কেউ কিছু লিখেন নি। জমির আয় অতি সামান্য। মামারা মাঝে মাঝে টাকা দিয়ে সাহায্য করেন। এখনো করছেন। কিনা কে জানে? পারুলের স্কুলের বেতন দেয়া হয়েছে কী? না নাম কাটিয়ে বাড়িতে বসে আছে। কিছু দিন আগে পারুলের চিঠি পেয়েছি সেখানে এসব কিছুই লেখা নেই। বাড়ির জন্যে বড় মন কাঁদতে লাগল।
জ্যোতির্ষিণবের কাছে একটু যে বসব সে উপায় নেই। তাঁর নাকি আবার কি এক মৌনব্রত শুরু হয়েছে। এক সপ্তাহ কারো সঙ্গে কথা বলবেন না। হাত দেখাতে যারা আসছে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। সফিক মৌনব্রতের প্রথম দিন চেঁচিয়ে বলেছে,
শুধু ভড়ং, রোজগার পাতি নাই কিনা তাই একটা নতুন ফিকির বের করেছে।
এর উত্তরে জ্যোতির্ষিণবশ্লেটে বড় বড় করে লিখেছেন, মৌনব্রত অবস্থায় আমাকে রাগাইও না।
সেই শ্লেট রেখে এসেছেন। সফিকের বিছানায়। সফিক রেগে মেগে অস্থির। তার এরকম রাগের অর্থও ঠিক বুঝতে পারি না। রোজগার বাড়াবার ফন্দিই যদি হয় তাতে ক্ষতি কী? ফন্দি ফিকির তো সবাই করে। তা এমনিতেও তার খুব তিরিক্ষি মেজাজ হয়েছে। কোন কারণ ছাড়াই রেগে ওঠে। করিম সাহেবের সঙ্গে অকারণে একটা ঝগড়া করল। করিম সাহেব রোজকার মত সন্ধ্যা বেলা গায়ে তেল মাখাচ্ছিলেন। সফিক গম্ভীর হয়ে বলল, এই কুৎসিত অভ্যাসটা ছাড়েন দেখি।
আপনার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
ঘরের সামনে একটা লোক নেংটা হয়ে তেল মাখায়–এটা সহ্য করা যায় না।
আমি নেংটা হয়ে তেল মাখাই। আমি?
তুমুল হৈচৈ বেঁধে গেল। নবী সাহেব এসে থামালেন।
সফিকের প্রেসের চাকরিটা নেই। কী নিয়ে গোলামাল করেছে কে জানে? লালুর সঙ্গে কাটা কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছে। সারাদিন রোদে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে। সন্ধ্যার পর যায় বয়স্কদের কী একটা স্কুলে। এই চাকরিটা সে কি করে যেন ধ্যা করে জোগাড় করে ফেলেছে। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে মাসে তাকে একশ টাকা করে যাতায়াত খরচ দেয়। এর বিনিময়ে বস্তির লোকদের সে বর্ণ পরিচয় পড়ায়। এই চাকরিতে সে খুব সম্ভষ্ট। হাসি মুখে আমাকে বলে,
সব গুণ্ডা-পাণ্ডাদের সঙ্গে খাতির হয়ে গেছে অনেকেই আমার ছাত্র কিনা। খুব মানে। দেখবি ওদের দিয়ে নিউ প্রেসের মালিককে রাম ধোলাই দিব একদিন। আর আমাদের রশীদ মিয়াকেও।
রশীদ মিয়া আবার কী করেছে?
মস্ত বড় চোর। দেখ না কী করি শালাকে।
আমার মনে হয় সফিকের কোনো একটা অসুখ করেছে। রাতে তার ভাল ঘুম হয় না–ছট ফট করে। প্রায়ই দেখা যায় অন্ধকার ঘরে স্টেভ জ্বালিয়ে চা করছে। রাতের বেলা তার চা খাওয়ার সঙ্গী নিশানাথ বাবু। দুজনে চুক চুক করে অন্ধকারে চা খায়-আবার ঝগড়াও করে।
আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি পড়াশুনা করতে। কিন্তু কিছুতেই মন বসে না। ক্লাসে বড় ঘুম পায়। প্রফেসররা একঘেয়ে সুরে কি বলেন তারাই জানেন। একেক সময় এমন নির্বোধ মনে হয় তাদের। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই চলে যাই সদরঘাট। লঞ্চ টার্মিনালের কাছে সফিক লালুকে নিয়ে কাটা কাপড় বিক্রি করে। জায়গাটা নাকি ভাল। ঘরে ফেরা মানুষেরা বেশি দরদাম করে না। ঝটপট কিনে ফেলে। আমাকে দেখলেই সফিক বিরক্ত হয়। গম্ভীর হয়ে বলে, ক্লাস ফাকি দিয়ে আসলি? মুশিবত দেখি। ক্লাসে যেতে সত্যি আমার ভাল লাগে না। কলেজের ছেলেগুলিকে আপন মনে হয় না কখনো। অনেক বেশি ভাল লাগে পান্থ নিবাসের লোকজনদের। এদের সাথে আমার পরিচয় অল্পদিনের-তবু মনে হয় যেন কত কালের চেনা। সিরাজ সাহেবের কথাই ধরা যাক। বয়সে আমার চেয়ে দশ বারো বৎসরের বড়। কিন্তু আমার সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলেন, যেন আমি তার দীর্ঘ দিনের বন্ধু। পয়ত্ৰিশের মত বয়স হয়েছে। বিয়ে করেছেন মাত্র গত বৎসর। বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই লাজুক ভঙ্গিতে বলেন, শুধু পয়সার অভাবে দেরি করলাম। কিন্তু বড় বেশি দেরি করে ফেলেছি। বউটার বয়স অল্প রে ভাই। মনে মনে বোধহয় কষ্ট পায়–বুড়ো হাসবেন্ড।
সিরাজ সাহেব প্রতি শনিবারে দেশে যান। সোমবার সকালে এসে অফিস ধরেন। শুক্রবার বিকালে তাঁর সঙ্গে বাজারে যেতে হয় আমাকে। খুটিনাটি কত কি যে দীরদাম করেন। মুখে কপট বিরক্তির রেখা।
বুঝলেন ভাই বিয়ে করার যন্ত্রণা! বাজারে ঘুরতে ভাল লাগে বলেন দেখি? গতবার যে নিয়ে গেলাম। লাল ফিতা? পছন্দ হয় নাই। রঙটা নাকি কটা। মেয়েদের মনের ঠিক পাওয়া মুশকিল রে ভাই।
সিরাজ সাহেবের বেঁটির আবার গল্পের বই পড়ার নেশা। মাঝে মাঝেই বই নিয়ে যাওয়ার ফরমাশ থাকে। বইয়ের দোকান ঘুরতে ঘুরতে ঘাম বেরিয়ে যায় আমার, বই আর সিরাজ সাহেবের পছন্দ হয় না। যে বই দেখানো হয়, সিরাজ সাহেব ঘাড় নাড়েন,–উঁহু মলাটে এটা পাখির ছবি নাকি? এই বই ভাল হবে কী করে ভাই? একটা ট্র্যাজিক বই দেখান না।