বুদ্ধি বের করেছি।
কী বুদ্ধি?
ছুটির দিনে কাটা কাপড়ের ব্যবসা করব। তুইও থাকবি।
সেটা কী রকম ব্যবসা?
সস্তা দরে দোকান থেকে কাটা কাপড়ের পিস কিনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বিক্রি করব। লাভের ব্যবসা। লালু সব ঠিক ঠাক করে দিবে।
লালুকে?
কাটা কাপড়ের ব্যবসা করে। ধুরন্ধর লোক। আমাকে খুব খাতির করে।
আমি হাসি মুখে বললাম, তুই বদলে গেছিস খুব।
সফিক ঘর ফাটিয়ে হা হা করে হাসতে লাগলো।
বদলাবনা তো কী? তুইও বদলাবি। দুবেলা না খেয়ে থাকলেই সব উলট পালট হয়ে যায় বুঝলি। একদিন তো রাস্তায় সুচ বিক্রি করলাম। মজার ব্যাপার খুব।
সফিক সিগারেট ধরিয়ে ফুসফুস করে টানতে লাগল। ওর আগেব সেই সুন্দর চেহারা আর নেই। চোখের নিচে কালি পড়েছে, গালের চোয়ালে উঁচু হয়ে সমস্ত চেহারাটাই কেমন যেন রুক্ষ হয়ে পড়েছে। সফিক হাসি মুখে বলল, সুচ বিক্রির গল্পটা শোন। একেবারে মরণ দশা তখন। চাকরি-বাকরি কিছুই নেই। হাতে জমানে টাকা-পয়সা যা ছিল সব শেষ। পুরা একটা দিন উপোস। দরজা বন্ধ করে খানিকক্ষণ কাদলাম! সন্ধ্যাবেলা বেরিয়েছি রাস্তায়। এমনি সময় এক লোক এসে বলল, সুচ নিবেন ভাই? ছয়টা চাইর আনা। আমি অবাক হয়ে বললাম, সুচ বিক্রি করে চলে তোমার? সেই লোক আমতা আমতা করে না স্যার চলে কই? ঘবে চারজন খানেওয়ালা। সেই রাত্রেই শুরু হল আমার সুচেব ব্যবসা। মূলধন জোগাড় করলাম জ্যোতির্ষিণবের কাছ থেকে। খুব লাভের ব্যবসা। পাঁচ টাকার সুচে দশটাকা লাভ।
লজা লাগত না তোর?
না লজা লাগবে কেন?
পরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা হয় নাই?
বেশি দিন সুচ বিক্রি করলে হয়ত হত। বেশি দিন করি নাই। তবে আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল একদিন। পেছন থেকে চিনতে পারিনি। যথারীতি বলেছি, আপা সুচ নেবেন, সস্তা করে দিচ্ছি। মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখে একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অনেক্ষণ কথাই বলতে পারল না। শেষটায় বলল, কাল সন্ধ্যায় একবার আমার বাসায় আসবেন? আসেন না। ঠিকানা রাখেন। আসবেন কিন্তু।
গিয়েছিলি?
গেলাম। রাজপ্রাসাদের মত বাড়ি। দেখলেই বুকের মধ্যে হুঁ হুঁ করে। মেয়েটিকে দেখে কে বলবে ওদের এত পয়সা। দারুণ মন খারাপ হয়ে গেল।
মেয়েটি সেই রাত্রেই কম্পোজিটারের একটা চাকরি জোগাড় করে দিল। প্রেসের মালিককে কী বলেছিল কে জানে, যাওয়া মাত্র এক মাসের এডভান্স বেতন।
মেয়েটা তো খুব ভাল।
ই ভাল মেয়ে। তোকে একদিন নিয়ে যাব।
সফিককে নিয়ে সেই দিনই কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। কলেজের প্রিন্সিপাল গম্ভীর মুখে বললেন, তিন বছর লস দিয়েছ দেখছি। এই তিন বৎসর করেছ কী?
কান টান লাল হয়ে গেল আমার। নিজের অভাব অনটনের কথা আমি নিজে মুখ ফুটে কখনো বলতে পারি না।
পুরানো বইয়ের দোকান থেকে কিছু বইপত্র জোগাড় করলাম। যে বাড়িতে প্রাইভেট টিউশনি জোগাড় হয়েছে সে বাড়িতেও সফিক আমাকে নিয়ে গেল। নয় দশ বছরের একটি মেয়ে আর ক্লাস ওয়ানের একটি ছেলেকে পড়াতে হবে। এদের মা নেই। বাবা ব্যস্ততার মধ্যে সময় করতে পারেন না। ভদ্রলোক বললেন, দুটিই ভীষণ শয়তান, অস্থির হয়ে পড়েছি আমি। দেখেন ভাই যদি কিছু করতে পারেন। বাচা দুটিকে ভাল লাগল। ছোটটি দেখি একটি পেনসিল দিয়ে বোনকে খোঁচা দেয়ার চেষ্টা করছে। বড়টির মুখের ভাব এরকম যে এই সব ছেলেমানুষী ব্যাপার দেখে সে বড়ই বিরক্ত। বাচ্চা দুটির খুব মায়া কাড়া চেহারা।
পান্থ নিবাসে ফিরে এলাম অনেক রাতে। জ্যোতির্ষিণবের ঘরে প্রদীপ জ্বলছে, তার মোটা গম্ভীর গলা শোনা যাচ্ছে, আপনার রবির ক্ষেত্রে ত্রিশুল চিহ্ন আছে। অতি শুভ লক্ষণ। হাজারে একটা পাওয়া যায় না। তবে মঙ্গলের ক্ষেত্র ভাল না। গ্রহ কুপিত হয়েছেন।
আজীজ সাহেবের ঘরে হৈ হৈ করে তাস খেলা হচ্ছে। তীক্ষা গলায় কে যেন চোঁচাচ্ছে, এটা নো ট্রাম্পের কল? মাথার মধ্যে কিছু আছে আপনার? গোবর পুরা মাথায় অফিসের কাজকর্ম করেন কী ভাবে?
বারান্দায় পাটি পেতে লম্বা শুয়ে শুয়ে আছেন করিম সাহেব। কাদের তার গায়ে তেল মাখাচ্ছে। আরামে চোখ ছোট হয়ে আসছে করিম সাহেবের। আমাদের দেখে টেনে টেনে বললেন, তেল মালিশের মত উপকারী কিছু নাই। দুইটাই চিকিৎসা আছে, জলি চিকিৎসা আর তেল চিকিৎসা।
পান্থ নিবাসে আমার জীবন শুরু হল। ১১ই মার্চ উনিশশো পয়ষট্টি সন।
বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে
বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে।
বাবা এবং মা দুজনেই দুটি পৃথক খামে চিঠি দিয়েছেন। বাবার চিঠি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। সে চিঠিতে নিজের ছেলে-মেয়ের কথা কিছুই নেই। স্টেশন মাস্টার এবং পোস্ট মাস্টারের কথা বিশদভাবে লেখা। বাবা লিখেছেন,
বেহালার দাম কত তা নিশ্চয়ই খোঁজ নিয়াছ। ভাল করিয়া অনুসন্ধান করিবে এবং বেজিস্টাবি চিঠি দিয়া আমাকে জানাইবে। এদিকের খবর ভাল তবে স্টেশন মাস্টার সাহেবের বড় বিপদ। তার চাকরি নিয়া ঝামেলা হইতেছে। হেড অফিস হইতে ইন্সপেকশন হইবে। বড় উদ্বিগ্ন আছি। আমাদের পোস্টমাস্টার সাহেবের মেজো মেয়ের বিবাহের দিন ধার্য হইয়াছে। ছেলে কাস্টমাসে চাকুরি করে। তিনশত পচাত্তর টাকা বেতন। পনরই ফায়ুন ইনশাল্লাহ বিবাহ, দেনা-পাওনা নিয়ে ছেলের এক মামার সহিত কিঞ্চিৎ মানো-মালিন্য হইয়াছে। মামাটি অতি অভদ্র। সাক্ষাতে সমস্ত বলিব।
মায়ের চিঠিটাও ছোট আমার পড়াশুনা নিয়ে উদ্বেগ। স্বাস্থ্য কেমন আছে। এখানকার খাওয়া দাওয়া কেমন, এই সব। কিন্তু শেষের দিকে লিখেছেন,