সফিক দুটি কাঁপে চা ঢালল। আমি বললাম, এত রাতে চা খাব না। সফিক।
তোর জন্যে না, নিশানাথকে ডেকে আনছি।
কিছুক্ষণ পরই নিশানাথ জ্যোতির্ষিণবের গজগজানি শোনা গেল, বাত দুপুবে চা? এই সব কী শুরু করেছ? যাও চা খাব না।
সফিকের গলা আরেক ধাপ উঁচুতে, বানানো হয়েছে চা খাবেন না মানে? খেতেই হবে।
আরে হুঁকুম নাকি তোমার?
একশ বার হুঁকুম? বানালাম। এত কষ্ট করে আব্বা তিনি খাবেন না। আলবত খাবেন।
সফিকের কাণ্ড কারখানা দেখে আমি স্তম্ভিত। জ্যোতির্ষাণব অবশ্যি খবম খাট খািট কবে ঘবে এলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করলেন, চা কোথায়? ওয়াক থু। এ তো ইদুব মাবা বিষ।
সফিক সে কথার উত্তর দিল না। খানিকক্ষণ চুপ চাপ থেকে শান্ত স্বরে বলল, একটা গল্প বলুন নিশানাথ বাবু।
জ্যোতির্ষিণব চায়ের কাপ নামিয়ে বেখে উদ্বিগ স্বাবে বললেন, কী হয়েছে তোমার?
কিছু হয় নাই।
না, বল কি হয়েছে?
সফিক ক্লান্ত স্বরে বলল, একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম আমার ছোট বোন অনু মবে পড়ে আছে। সাত আটটা কাক তার পাশে বসে আছে।
নিশানাথ গম্ভীর হয়ে বললেন, শেষ প্রহরের স্বপ্ন। তার উপর এখন শুক্ল পক্ষ–স্বপ্নের কোনই মানে নেই। নাক ডাকিযে ঘুমাও।
একেবারে যে মানে নেই তা না নিশানাথ বাবু। অনুব হাসবেন্ডটা আরেকটা বিয়ে কবছে। সোমবার চিঠি পেয়েছি। মনটা বড় অস্থির। সন্ধ্যাবেলা আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি, কিছু মনে করবেন না। আমার মাথা ঠিক নাই। নিশানাথ বাবু কিছু বললেন না। চা শেষ করে নিঃশব্দে চলে গেলেন। আমি শুয়েই ছিলাম, ঘুম আসছিল না। সফিক জেগে রইল অনেকক্ষণ।
এই সফিক কী যে ক্যাবলা ছিল। একা একা স্কুলে আসতে ভয় পেত বলে রোজ তার বাবা স্কুলে দিয়ে যেতেন। টিফিনের সময় আমরা সবাই যখন ছোটাছুটি করে কুমীর কুমীর খেলি, তখন সে উদাস চোখে জানোলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে। অংক স্যার একদিন বেগে গিয়ে বললেন, সবাই খেলছে আর তুই বসে আছিস? রহমান যা তো ওর কান মলে দে।
রহমান আমাদের ক্লাস ক্যাপটেন। সে গিয়ে কান চেপে ধরতেই সফিকের নিঃশব্দ কান্না। আমরা হোসে বাঁচি না। একদিন সফিকের বাসায় গিয়ে দেখি তার মা ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন। ক্লাস ফোরে পড়ে ছেলে, মায়ের হাত ছাড়া খেতে পারে না! কি কাণ্ড কী কাণ্ড।
আমার ঘুম ভাঙলো খুব সকালে। বাইরে এসে দেখি একটি লোক হাফ পেন্ট পড়ে উঠ বাস করছে। আমাকে দেখে সে মনে হল একটু লজ্জা পেল। ইতস্তত করে বলল, সফিক সাহেবের বন্ধু আপনি?
জি।
আমি আজীজ। রেলে চাকরি করি। শরীরটা ঠিক রাখতে হয় ভাই। যা খাটনি।
আমি কিছু বললাম না। আজীজ সাহেব গায়ের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, আপনার মত রোগা পটকা হলে এত দিনে যক্ষ্মা হয়ে মরে যেতাম। শরীরের জন্যে টিকে আছি। ওয়াগন বুকিং-এর চাকরি যে কবে সেই জানে।
আমি লক্ষ্য করে দেখলাম লোকটির স্বাস্থ্য সত্যি ভাল। সচরাচর এমন চোখে পড়ে না। আমি হাসি মুখে বললাম, বেশ স্বাস্থ্য আপনার।
আর স্বাস্থ্য। খাওয়া জুটিাতে পারি না ভাই। শুধু ভিজা ছোলা খেয়ে কী স্বাস্থ্যু হয়? সারাক্ষণ ক্ষিধে লেগে থাকে। আসলাম পালোয়ান সকাল বেলা দশটা ডিম আর এক সেরা গোস্তের কিমা খাদ্য। এই সব জিনিস পাব কোথায় বলেন?
আজীজ সাহেব জোর কবে টেনে নিয়ে গেলেন বেলেব সরবত খাওয়ার জন্যে। এতে নাকি পেট ঠাণ্ডা থাকে। আজীজ সাহেবের ঘরটি বেশ বড়। তিনি এবং করিম সাহেব দুজনে মিলে থাকেন। করিম সাহেব লোকটি কংকালসার। মাথায় কোন চুল নেই। কিন্তু মুখ ভর্তি প্রকাণ্ড গোফ।
করিম সাহেব ইনি সফিক ভায়ের বন্ধু, এখানে থাকবেন।
করিম সাহেব হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে নিচে নেমে গেলেন। তুমুল ঝগড়া শুরু হয়ে গেল তার পরই। কবিম সাহেব বাঁশীব মত চিকন গলায় চিৎকার করছেন, এত বড় বালতিটা চোখে পরল না?
বালতির মধ্যে নাম লেখা আছে, যে দেখলেই চিনব?
টেরা টেরা কথা বলবেন না।
টেরা কথা কে বলে, আমি না। আপনি?
যত ছোট লোকের আড়া হয়েছে।
মুখ সামলে কথা বলবেন সাহেব।
একজন অতি বৃদ্ধ লোক দেখলাম, কী বলে যেন দু’জনকেই থামাতে চেষ্টা করছেন। আজীজ
উনি নবী সাহেব। গার্লস স্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টার ছিলেন। রিটায়ার করেছেন। অবস্থাটা দেখেছেন? রাতে চোখে একেবারেই দেখতে পান না। হাত ধরে বাথরুমে নিতে হয়।
উনি নাকি ঘর ছেড়ে দিবেন, সফিক বলল।
আজীজ সাহেব গলা নিচু করে বললেন, পাগল হয়েছেন, শিকড় গজিয়ে গেছে। এই ঘর ছেড়ে যাবেন না কোথাও। দুই মেয়ে থাকে ঢাকা–জামাইরা বড় চাকুরে, তারা নেবাব চেষ্টা কম কবে নাই, নিজের চোখে দেখা। ছোট মেয়েটার কত কান্না কাটি…।
নবী সাহেব ঝগড়াটা থামিয়ে ফেললেন। তারপর নিচু গলায় ডাকতে লাগলেন, এই কাদের। এই কাদের। কাদের এই মেসের বাবুর্চি-টাবুর্চি হবে। সে এসে হাত ধরে তাকে উপরে নিয়ে এল। আজীজ সাহেব ফিসফিস করে বললেন, বুড়ার দিন শেষ হয়ে আসছে। হাঁপানি আছে, ডায়াবেটিস আছে, সারারাত খক খ্যক করে কাশে। কিন্তু তেজ কী–মেয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকবে না। এত তেজ ভাল না রে ভাই। এখন আরাম নেয়ার সময়, কী বলেন?
তা তো ঠিকই।
বুড়া হলে বুদ্ধিাশুদ্ধি কিছু থাকে না।
সফিক ঘুম থেকে উঠে অন্য মানুষ। হাঁসি-খুশি ভাবভঙ্গি। চা খেতে খেতে বলল,
তোর কোনো চিন্তা নাই, প্রাইভেট টিউশনি ঠিক করে রেখেছি। সপ্তায় পাঁচ দিন যাবি। চোখ বন্ধ করে কলেজে ভর্তি হয়ে যা। শচারেক টাকাও জমিয়েছি। অসুবিধা হবে না। তা ছাড়া আরেকটা