আমি চুপ করে থাকি। সাধুজী রাগী গলায় বললেন, হাত দেখা বিজনেস হলে আজ আমার গাড়ি বাড়ি থাকত। সুসং দুর্গাপুরের জমিদার ভূপতি সিংহ আমার ঠাকুরদাকে আশি বিঘা লাখেরাজ সম্পত্তি দিতে চাইলেন। ঠাকুরদা বললেন, ক্ষমা করবেন, দরিদ্র ব্ৰাহ্মণ। সম্পত্তির মোহে পড়তে চাই না। রশীদ মিয়া কী বুঝবে আমাদের ধারা?
সফিক ফিরতেই তুমুল ঝগড়া শুরু হয়ে গেল জ্যোতির্ষিণবের সঙ্গে। সফিক গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, আমার ঘরের চাবি দিয়ে গেলাম আপনার কাছে। বললাম, রঞ্জু আসামাত্র আমার ঘর খুলে দেবেন তা না নিজের অন্ধ কূপের ধোয়ার মধ্যে নিয়ে…
তাতে তোমার বন্ধুর কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয়েছে?
না হোক মেসে রঞ্জুর জন্যে রান্না করতে বলে গেছি। টাকা খরচ করে তাকে হোটেল থেকে খাইয়ে এনেছেন। টাকা সস্তা হয়েছে?
টাকার মূল্য আমার কাছে কোনো কালেই নেই সফিক।
বড় বড় কথা বলবেন না। লম্বা লম্বা বাত শুনতে ভাল লাগে না। সামান্য ব্যাপার নিয়ে সফিক এত হৈচৈ করছে কেন বুঝতে পারলাম না। আমার লজ্জার সীমা রইল না।
সফিকের ঘরে দুটি চৌকি পাতা। আবর্জনার স্তুপ চারদিকে। দীর্ঘ দিন সম্ভবত ঝাঁট দেয়া হয় না। একপাশে একটি থালায় অভুক্ত ভাত পড়ে আছে। সফিক আমাকে বলল, লম্বা হয়ে শুয়ে পড়। সকালে কথা বলব।
তুই কোথায় যাস?
খেয়ে আসি। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। খেয়ে এসেই বিছানায় কান্ত হব। কথাবার্তা যা হবার সকালে হবে। তুই ঘুমো।
সফিক নিচে নেমেও খুব হৈচৈ করতে লাগল, হারামজাদা ডাল শেষ হয়ে গেছে মানে? পয়সা দেই না। আমি? আমি মাগনা খাই? যেখান থেকে পারিস ডাল নিয়ে আয়।
সাধু বাবা ডাল খেয়ে ফেলেছে।
সাধু বাবার বাপের ডাল।
সফিক বড় বদলে গেছে। এ রকম ছিল না। কখনো শরীরও খুব খারাপ হয়েছে। কোনো অসুখবিসুখ বাঁধিয়েছে কিনা কে জানে। আমি তো প্রথম দেখে চিনতেই পারিনি। চমৎকার চেহারা ছিল সফিকের। স্কুলে ‘মুকুট’ নাটক করেছিলাম আমরা। সফিক হয়েছিল মধ্যম রাজকুমার। সত্যিকার রাজপুত্রের মত লাগিছিল। কমিশনার সাহেবের বৌ সফিককে ডেকে পাঠিয়ে কত কি বলেছিলেন।
সফিক আমাকে নিয়ে গেল রশীদ মিয়ার কাছে
সকাল বেলা সফিক আমাকে নিয়ে গেল রশীদ মিয়ার কাছে। রশীদ মিয়া তার রেজিস্ট্রি খাতায় আমার নাম তুলবেন। লোকটি ছোটখাটো। সামনের দুটি দাঁত সোনা দিয়ে বঁধানো। সেই দাঁত দুটি ছাড়া আর সমস্ত দাঁতে কুৎসিত হলুদ রঙ। আমি পান্থনিবাসে বোর্ডার হব শুনে তিনি এমন ভাব করলেন যেন এমন অদ্ভুত কথা এর আগে শোনেননি।
না। সাহেব বোর্ডার আর নেব না। শুধু শুধু ঝামেলা।
কিসের ঝামেলা?
টাকা পয়সা নিয়ে খোঁচামেচি করে।
আমি, আমি খোঁচামেচি করি?
আপনি না করেন। অন্য লোকে করে।
আমাকে নিয়ে কথা। আমি যদি না করি এও করবে না। মাসের তিন তারিখে খ্যাচাং করে টাকা ফেলে দিবে। নবী সাহেবের ঘরটা দেন তার নামে।
নবী সাহেব গেলে তবে তো দিব?
যতদিন না যান ততদিন থাকবে আমার ঘরে।
রশীদ মিয়া অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
ঐ ঘরের ভাড়া এই মাস থেকে পাঁচ টাকা বেশি।
সফিক প্রায় তেড়ে গেল।
পাঁচ টাকা বেশি কেন? মোজাইক করে দিচ্ছেন্ন ঘরটিা?
রশীদ মিয়া নির্লিপ্ত সুরে বলল,
জানালা দুইটা। ঐ ঘরে আলো বাতাস বেশি খেলে।
একটা জানালা পেরেক মেরে বন্ধ করে দিবেন। সাফ কথা। খুলেন আপনার খাতা।
নিতান্ত গোমড়া মুখে খাতা খুললো রশীদ মিয়া।
পেশা কী?
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
পেশা কিছু নাই – আমি ছাত্র।
ঝপাং করে খাতা বন্ধ করে রশীদ মিয়া আতংকিত স্বরে বললেন,
ছাত্র মানুষ ঘর ভাড়া পাবে কোথায়?
সফিক থমথমে গলায় বলল, যেখান থেকে পারে জোগাড় করবে। দরকার হয় চুরি করবে।
চুরি করবে?
হ্যাঁ, চুরি করবে। অসুবিধা আছে কিছু? আপনি করেন না?
আমি চুরি করি?
মালিকের পান্থনিবাস তো ফাঁকা করে দিচ্ছেন।
রশীদ মিয়ার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এলো।
কে, কে বলেছে?
বলা বলির তো কিছু নেই। সবাই জানে। সাধুজী তো পরিষ্কার বলেছেন, তীক্ষ্ণ চিবুক, ছোট কান এবং বর্তুলাকার চক্ষুর জাতক চোর স্বভাববিশিষ্ট হয়।
নিশানাথ এই কথা বলে?
হ্যাঁ বলবে না কেন? সাধুজী স্পষ্ট কথার লোক।
এরপর আর আমার নাম-ধাম খাতায় তুলতে অসুবিধা হয় না। রশীদ মিয়া গম্ভীর গলায় উপদেশও কিছু দেন, ঘরে মেয়ে ছেলে আনতে পারবেন না। ভদ্রলোকের মেস এইটা। ধান্ধাবাজির জায়গা না। বিশিষ্ট লোকজন থাকে।
অগ্রিম এক মাসের খাওয়া খরচের টাকা দেয় সফিক। তারপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রশীদ মিয়ার পেটে হাত দিয়ে বলে, মাশআল্লাহ পেট তো আপনার আরো পােচ গিরা বড় হয়ে গেছে রশীদ মিয়া। সফিককে যতই দেখি ততই অবাক হই। এ কোন সফিক? দুবৎসরে তার এ কি পরিবর্তন!
মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল একবার। দেখি ঘরের মধ্যে লালচে আলো। সমুদ্র গর্জনের মত শাশা আওয়াজ হচ্ছে। ধরা মড় করে জেগে উঠে দেখি সফিক স্টেভ জ্বালিয়েছে।
কি ব্যাপার সফিক?
ব্যাপার কিছু না, চা খাব।
চা এই সময়? কিয়টা বাজে?
তিনটা দশ। তুই খাবি নাকি?
না।
রোজ এই সময় চা খাস নাকি?
না দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলো, ভাবলাম একটু চা খাই।
আমি চুপ করে থাকলাম। সফিক ক্লান্ত স্বরে বলল,
বড় স্ট্রগল করতে হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়েছি জানিস না বোধ হয়?
আমি জানতাম না। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
কী করে পড়ব বল? দিনে কম্পোজিটারের চাকরি। বিকালে টিউশনি আছে দুটো। এর পর আর এনার্জি থাকে না। নাইট কলেজে পাস কোর্সে নাম তোলা আছে। এই বছর আর হবে না।