বাবা চোখে-মুখে দারুণ দুঃশ্চিন্তার ছাপ ফুটিয়ে বলেন, বড়ই মুসিবত দেখছি। গভীর সমুদ্র। হঁ যত মুশকিল তত আহসান। হাদিস কোরানের কথা। চিন্তার কিছু দেখি না। সমস্যার সমাধানও বের করেন সঙ্গে সঙ্গে, দরকার নাই স্কুলে পড়ার। পারুল মা, প্রাইভেটে মেট্রিক দিবে তুমি। আমি পড়াব তোমাকে। বইগুলি সব নিয়ে আয় তো মা এবং তিন নম্বরি একটা খাতা আন, রুটিনটা লেখি আগে।
মা ছাড়া আমরা কেউ বিরক্ত হই না বাবার ওপর। আমরা ছোটবেলা থেকেই জানি বাবা এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। এই জগতের দুঃখ কষ্টের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই।
আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে বাবা স্টেশনে এসেছিলেন। ট্রেন ছাড়বার আগে আগে আমাকে বললেন,
রঞ্জু, একটু এদিকে শুনে যা তো।
পারুল আর আনজ্বর কাছে থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে গেলেন আমাকে। গলার স্বর যথাসম্ভব নিচু করে বললেন, একটা ভাল বেহালার দাম কত, খোঁজ নিবি তো। ভুলিস না যেন।
খোঁজ নিব। ভুলব না।
আমার নিজের জন্যে না। বুড় বয়সে কী আর গান বাজনা হয়? তোর মাও পছন্দ করে না। অন্য লোকের জন্য।
আমি খোঁজ নিব।
ট্রেন ছাড়ার সময়ও এক কাণ্ড করলেন। ট্রেনের সঙ্গে দৌড়াতে শুরু করলেন। ট্রেনের গতি যত বাড়ে তার গতিও বাড়ে। ট্রেনের লোকজন গলা বাড়িয়ে মজা দেখতে লাগল।
গোসল সেরে দোতলায় উঠে এসে দেখি জ্যোতির্ষিণবের ঘর জমজমাট। দুতিন জন লোক বসে আছে পাংশু মুখে। জ্যোতির্ষিণব একজনের হাতের তালুর দিকে অখণ্ড মনযোগে তাকিয়ে আছেন। আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, পর্দা ঠেলে ভেতরে চলে যাও। চা পিরিচে ঢাকা।
আগে লক্ষ্য করিনি যে পায়রায় খুপড়ির মত ঘরও পর্দা দিয়ে দুভাগ করা। ভেতরে ঢুকে দেখি দড়ির খাটিয়ার উপর ধবধবে সাদা চাদরে চমৎকার বিছানা করা। বিছানার লাগোয়া একহাত বাই একহাত সাইজের টেবিল একটি। তার উপরও ধবধবে সাদা ঢাকনি। খাটিয়াটার মাথার পাশে বেতের শেলফ। শেলফের উপর চমৎকার একটি কাচের ফুলদানীতে ফুল। আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। জ্যোতিষণিব দেখি দারুণ সৌখিন লোক।
শুধু চা নয়। পিরিচে খাবার ঢাকা আছে। একটি লাড়ু এবং একটি সিঙ্গারা। আমি চ খেতে খেতে শুনলাম জ্যোতির্ষিণব গম্ভীর গলায় বলছেন, গ্রহ শান্তি কবচ নিতে পারেন আমার কাছ থেকে। রত্নও ধারণ করতে পারেন। তবে রত্ন অনেক দামী। তাছাড়া আসল জিনিস মিলবে না, চারদিকে জুয়াচুরি।
গ্রহ শান্তিতে কত খরচ পড়বে?
বিশ টাকা নেই। আমি, তবে আপনার জন্যে দশ।
দশ যে বড় বেশি হয়ে যায় সাধুজী।
জ্যোতির্ষাণব হাসেন।
পঞ্চ ধাতুর কবজের দামই মশাই পাঁচ টাকা। তাম্র স্বর্ণ রৌপ্য পারা ও দস্তা। তঞ্চকতা পাবেন না। আমার কাছে। একবার ধারণ করে দেখুন টাকাটা জলে যায় কিনা। টাকাই তো জীবনের সব নয়। হুঁ হুঁ।
বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি ধরে যায় আমার। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে, ঘর অন্ধকার। সুইচ আছে একটি। আলো জ্বালাতে ঠিক সাহস হয় না। সাধুজী পাশের ঘরে প্রদীপ জেলে বসে আছেন। কে জানে ইলেকট্রিসিটির আলোতে তার হয়ত অসুবিধা হবে। সফিক কত রাতে ফিরবে কে জানে? শুয়ে পড়লাম সাধুজীর বিছানাতেই।
শুয়ে শুয়ে কত কি মনে হয়। বাবা যেন ম্যাকমিলান কোম্পানির তার সেই পুরানো চাকরিটা আবার ফিরে পেয়েছেন। গভীর রাত্রে বাড়ি ফিরেছেন প্রকাণ্ড একটা মাছ হাতে নিয়ে। পারুলের বিছানার পাশে ঝুকে ডাকছেন,
ওরে পারুল, ওরে টুনটুনি, ওরে কুট কুট, ওরে ভুটি ভুটি।
মা কপট রাগের ভঙ্গি করে বলছেন, কি যে পাগলামী তোমার। এই দুপুর রাতে মাছ কুটিতে বসব নাকি?
বাবার মুখ ভর্তি হাসি।
একশ বার বসবে। হাজার বার বসবে।
পারুল ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে। বার বার বলছে,
বইটা এনেছ বাবা? দেশ বিদেশের রূপকথা নাম লিখে চিঠি দিয়েছিলাম যে তোমাকে?
উঁহু, বডড ভুল হয়ে গেছে রে। একটুও মনে নেই। সামনের শনিবার ঠিক দেখিস…
পারুলের নিচের ঠোট বেঁকে যেতে শুরু করতেই বাবা ম্যাজিসিয়ানের ভঙ্গিতে বলে উঠেছেন,
টেবিলের উপর রূপকথার বইটা আবার কে আনল?
ঝিমুনি ধরলেও ঘুম আসে না আমার। বিছানায় এপােশ ওপাশ করি। ধূপের গন্ধে দম আটকে আসে একেকবার। কী যে কাণ্ড সাধুজীর। সফিক চিঠিতে লিখেছিল, দুনিয়াতে মন্দ মানুষ এত বেশি বলেই ভাল মানুষদের জন্য আঁমাদের এত মন কাঁদে। আমাদের নিশানাথ এমন একজন ভাল মানুষ। মানুষকে দেওয়াই যার জীবিকা— সে এমন ভাল মানুষ হয় কি করে কে জানে?
রাত নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও সফিকের দেখা পাওয়া গেল না। নিশানাথ বাবু আমাকে বসিয়ে রেখে নিচে খেতে গেলেন। খাওয়ার পর আমাকে হোটেল থেকে খাইয়ে আনবেন।
হোটেলটি বেশ খানিকটা দূরে। নানান প্রসঙ্গে গল্প করতে করতে সাধুজী হাঁটছেন। অনেকেই দেখি তাঁকে চেনে। একটি পানওয়ালা দাঁত বের করে বললো, সাধুজীর শইলটা বালা নাকি?
তিনি থেমে বেশ খানিকক্ষণ কথাবার্তা বললেন পানওয়ালার সঙ্গে। তার গল্প বলার ঢং চমৎকার। মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। সফিক প্রসঙ্গে বলেন, সফিক ছেলেটা ভাল তবে বড় ফাজিল। ফাজলামী করে আমার সঙ্গে। আমি নাকি লোক ঠকিয়ে খাই। ছিঃ ছিঃ কি কুৎসিত চিন্তা। আমরা হচ্ছি তিন পুরুষের জ্যোতিষী। আমার ঠাকুরদা। তারানাথ চক্রবর্তী ছিলেন সাক্ষাৎ বিভূতি। মানুষের হাত দেখে জন্মবার বলতে পারতেন। আজকালকার ছেলে।পুলেরা এসবের কী জানবে?
কথা বলতে বলতে সাধুজীর মুখের ভাব বদলায়। রশীদ মিয়ার কথা বলতে বলতে তিনি চোেখ-মুখ কুঁচকে এমন ভাবে তাকান যেন রশীদ মিয়া ছুরি হাতে মারতে আসছে। রশীদ মিয়া, বুঝলে নাকি রঞ্জু? নরকের কীট। দেখা হলেই বলবে–বিজনেস কেমন চলছে আপনার?