নিশানাথ বাবু শান্ত গলায় বললেন, তুমি ভাল সফিক?
আমি কেমন আছি তা দিয়ে আপনার কোন দরকার নিশানাথ বাবু? আমি দৌড়ে গিয়ে নিশানাথ বাবুর হাত ধরে ফেললাম। গাঢ় স্বরে বললাম, আসেন। ঘরে আসেন।
প্রায় দুমাস পর দেখছি জ্যোতির্ষিণবকে। গেরুয়া পাঞ্জাবি ছাড়া সব কিছু আগের মতই আছে। পাঞ্জাবির বদলে সাদা রঙের একটি শার্ট। বেশ খানিকটা রোগ লাগছে। চোখ দুটি যেন অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। নাকি আমার দেখার ভুল।
সফিক এমন একটা ভাব করতে লাগল যেন জ্যোতির্ষাণবের ফিরে আসাটা তেমন কোন ব্যাপার নয়। সাধুজী যেন চা খেতে গিয়েছিল। চা খেয়ে ফিরে এসেছে। সে গুন গুন করে কী একটা গানের কলি ভাজিল। তারপর গভীর মনোযোগের সঙ্গে হিসাবপত্রের খাতা বের করে কী যেন দেখতে লাগল। এমন সব ছেলেমানুষী কাণ্ড সফিকের। শেষ পর্যন্ত আমার অসহ্য বোধ হল। চেঁচিয়ে বললাম, বন্ধ করা তো খাতাটা।
সফিক খাতা বন্ধ করে গম্ভীর স্বরে বলল, নিশানাথ জ্যোতির্ষিণব, আপনাকে আমাদের ম্যানেজার করা হয়েছে।
কিসের ম্যানেজার?
চায়ের দোকান দিয়েছি আমরা।
জ্যোতির্ষিণবের ঠোঁটের কোণায় হাসি খেলে গেল। হালকা গলায় বললেন, সত্যি সত্যি শেষ পর্যন্ত রেস্টুরেন্ট দিয়েছ?
হ্যাঁ ঘর ভাড়া হয়ে গেছে।
ঘর ভাড়া হয়ে গেছে।
হুঁ।
জ্যোতির্ষিণব হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন। অনেকক্ষণ আর কেউ কোন কথা বলল না। সফিক মৃদু স্বরে বলল, নৈশব্দের পরী উড়ে গেছে তাই না নিশানাথ বাবু? হঠাৎ সবাই চুপ করলে পরী উড়ে যায়। তাই না?
জ্যোতির্ষিণব মৃদু স্বরে বললেন, তোমার অসুখটা সেড়েছে সফিক?
হ্যাঁ সেরেছে।
জ্বর আসেনা আর?
আর কোনোদিন আসবে না।
আমি বললাম, আপনি কোথায় ছিলেন এতদিন?
জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়ালাম।
খেতেন কী?
আশ্চর্যের কথা কী জান? খাওয়া জুটে গেছে। না খেয়ে থাকিনি কখনো। পান্থ নিবাসে বরং আমার কষ্ট হয়েছে বেশি।
সফিক দৃঢ় স্বরে বলল, আর কষ্ট হবে না। আর কখনো না খেয়ে থাকতে হবে না। দেখবেন দিনকাল পাল্টে ফেলব।
নিশানাথ বাবু একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। যেন সফিকের কথাটি ঠিক নয়। সফিক ভুল বলছে। আমি বললাম, আমাদের কিছু না বলে চলে গেলেন কেন?
খুব মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। মায়া কাটানোর জন্যেই এটা করেছি।
সফিক কড়া গলায় বলল, মায়া কেটেছে?
নিশানাথ বাবু থেমে বললেন, মায়া কাটছে সফিক।
তাহলে ফিরে আসলেন কেন?
জ্যোতির্ষিণব তার জবাব না দিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগলেন। যেন খুব একটি ছেলেমানুষী প্রশ্ন তাকে করা হয়েছে। কিন্তু নটা বেজে যাচ্ছে। আমি আর থাকতে পারি না। আমি উঠে দাঁড়ালাম, এক ঘণ্টার মধ্যে আমি আসব। একটা খুব জরুরি কাজ আছে না গেলেই নয়।
জ্যোতির্ষিণব আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগলেন।
আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা।
শেলীর বাবা বললেন, তোমার দেরি দেখে ভাবলাম হয়তো আসবে না। গাড়ি পাঠাব। কিনা তাই ভূড়ামু, শেলীর মা কোণার দিকে একটি সোফায় বসেছিলেন, তিনি গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, শেলী শেলী।
শেলী এসে দাঁড়াল পর্দার ও পাশে। হয়ত সে এখানে আসতে লজ্জা পাচ্ছে। সে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, কী জন্যে ডাকছ মা।
ভেতরে আস। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?
বল না। কী জন্য ডাকছ?
তোমার স্যারকে চা দাও।
শেলীর বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, দুপুর রাতে চা কেন? টেবিলে খাবার দিতে বল। তুমি নিশ্চয়ই খেয়ে আসনি? আর খেয়ে এসে থাকলেও বস।
খাবার টেবিলে অনেক কথা বললেন ভদ্রলোক। কত কষ্ট করে পড়াশুনা করেছেন। মানুষের বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে থাকতেন। সেই সব কথা বলছেন গর্ব এবং অহংকারের সঙ্গে। একজন সফল মানুষের মুখে তার দুর্ভাগ্যের দিনের কথা শুনতে ভালই লাগে। শেলীর মা একবার শুধু বললেন, এই সব কথা ছাড়া তোমার অন্য গল্প নাই?
ভদ্রলোক হা হা করে হাসতে লাগলেন। যেন মজার একটি কথা বলা হয়েছে। শেলী একটি কথাও বলল না একবার ফিরেও তাকাল না আমার দিকে। একটি গাঢ় নীল রঙ্গের শাড়িতে তাকে জলপরীর মত লাগছিল। শাড়িতে কখনো দেখিনি তাকে! এ যেন অন্য একটি মেয়ে। শেলীর মা খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করছিলেন, ক ভাই বোন আমরা। কী তাদের নাম। কী করছে। পান্থ নিবাসে থেকে পড়াশুনা করতে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়। পড়াশুনা শেষ করে কী করব?
খাওয়া শেষ হতেই আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, আমি কী এখন যাব?
ভদ্রলোক আবার হা হা করে হেসে উঠলেন। যেন এই কথাটিও অত্যন্ত মজার। বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই যাবে। তবে তুমি একটা কাজ কর আমার এখানে অনেক খালি ঘর পড়ে আছে। তুমি আমার এখানে এসে থাক।
শেলীর মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আমিও তাই ভাবছিলাম। তুমি চলে আস এখানে পড়াশুনার তোমার খুব সুবিধা হবে। তা ছাড়া শেলী বেচারী খুব একলা হয়ে পড়েছে। তুমি থাকলে ওর একজন সঙ্গী হয়। বলতে বলতে মুখ টিপে হাসলেন। শেলীর দিকে ফিরে বললেন, ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল তো মা। তোমার স্যারকে পৌঁছে দিয়ে আসুক। রাত হয়ে গেছে।
শেলী আমাকে গোট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসল। কিছু একটা বলা উচিত তাকে। কিন্তু কোন কথাই বলতে পারলাম না। গাড়িতে ওঠার সময় শেলী শান্ত স্বরে বললো, আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে।
ঘরে ফিরে দেখি সফিক শুয়ে আছে। তার চোখ ঈষৎ রক্তাভ। বোধহয় আবার জর আসছে। সফিক ক্লান্ত স্বরে বলল, নিশানাথ চলে গেছে। বিদায় নিতে এসেছিল আমাদের কাছে।